টুঙ্গিপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বড় ডুমরিয়া। এ গ্রামের সর্বজনীন দুর্গা মন্দিরে পাটি বা মাদুর বিছিয়ে চলছে ছোট ছোট শিশুদের পাঠদান।
এখানে গ্রামাঞ্চলের মানুষ তাদের সন্তানকে প্রথম পাঠশালায় পাঠান। সেখান থেকে বর্ণমালার হাতেখড়ি হয়। বর্ণমালা, বাল্যশিক্ষা, শতকিয়া ও নামতার পাঠ চুকিয়ে তাদেরকে ভর্তি করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপযুক্ত করে শিশুদের গড়ে তোলা হয় এই পাঠশালায়।
জেলার এই গ্রামটিতে এখনো টিকে রয়েছে তালপাতার পাঠশালা। হাতে-মুখে কালি মেখে ছোট-ছোট শিশুরা বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে তালপাতার উপর লিখে লিখে প্রথম বর্ণমালা শেখেন।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি এখানে পাঠশালা শিক্ষা বিদ্যমান। ৫৩ বছর ধরে চলে আসা এ তালপাতার পাঠশালা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। সম্পূর্ণ স্থানীয়দের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে এ পাঠশালা।
শিক্ষার্থী প্রতি মাসে একশ’ টাকা করে বেতন হিসাবে দেয়া হয় শিক্ষককে। আগে সারা বছর শিক্ষার্থী প্রতি শিক্ষক নিতেন এক মন ধান।
নিম্ন বিলাঞ্চলের এ গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষানুরাগী রথীন্দ্রনাথ মালো এ পাঠশালাটি গড়ে তোলেন। গ্রামের গাছতলা বা কারো বাড়ির আঙ্গিনা ঘুরে ঘুরে এখন পাঠশালাটির স্থান হয়েছে দুর্গা মন্দির চত্বরে। এখানে কাঠি গ্রাম, কানাই নগর, ভৈরব নগর, ডুমরিয়া, ছোটডুমরিয়া ও বড়ডুমরিয়া গ্রামের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে।
বর্তমানে এ পাঠশালায় ২২ শিশু তাল পাতায় বর্ণমালা আয়ত্তে মনোনিবেশ করে পাঠ গ্রহণ করছেন।
ডুমরিয়া গ্রামের অভিভাবক মাধব বসু (৮০) বলেন, তালপাতায় শিক্ষকের এঁকেদেয়া বর্ণমালার উপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বর্ণমালা লেখার অভ্যাস করে শিক্ষার্থীরা। এ অভ্যাসে হাতের লেখা ভালো হয় বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর আগে আমরা শিশুদের পাঠশালায় পাঠাই। তাছাড়া পাঠশালায় বাল্যশিক্ষা, শতকিয়া, নামতা, বানানও শেখানো হয়। শিশুদের বেড়ে উঠতে এবং চরিত্র গঠনে প্রাথমিক ধাপ হিসাবে বাল্যশিক্ষা আগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
এ পাঠশালার সাবেক শিক্ষার্থী সরোজ বিশ্বাস (২৩) বলেন, এখান থেকে হাতে খড়ি নিয়ে কলেজের গন্ডি পেড়িয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছি। পাঠশালার বাল্যশিক্ষা আমার জীবনের ভিত্তি মজবুত করে দিয়েছে। এ শিক্ষা আমার কাজে লাগছে। এখানে শিক্ষা জীবন শুরু করেছি। তালাপাতায় বর্ণমালা আয়ত্ত করেছি। তাই আমার হাতের লেখা অনেক সুন্দর হয়েছে।
পাঠশালার শিক্ষক শিউলী মজুমদার বলেন, আমি তালপাতায় প্রথমে বর্ণমালা খোঁদাই করে দেই। শিক্ষার্থীরা কয়লা দিয়ে বানানো কালিতে কঞ্চির কলম ভিজিয়ে খোঁদাই করা তাল পাতার বর্ণমালার উপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তা আয়ত্ত করে। এ পদ্ধতিতে বর্ণমালা লেখার চর্চা করলে হাতের লেখা সুন্দর হয়।
তিনি বললেন, শিক্ষা গ্রহণের প্রথম দিকে যেসব শিশু কাগজ আর শীশকলম দিয়ে লেখা শেখে তাদের হাতের লেখা অত সুন্দর হয় না। ২২ শিশুকে পাঠশাশায় পাঠ দান করিয়ে মাসে মাত্র ২ হাজার ২শ’ টাকা পাই। এ দিয়ে সংসার চলে না। সরকার পাঠশালার দিকে নজর দিলে আমরা উপকৃত হতাম।
বড় ডুমরিয়া গ্রামের বঙ্গবন্ধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, শিশুর প্রথম পাঠ এখান থেকে শুরু হয়। এটি এ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। পাঠশালাটির নিজস্ব ঠিকানা নেই। সরকারি কোন সহযোগিতাও পায় না। তাই পাঠশালার জন্য এ দু’টি বিষয় নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
গোপালগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র হালদার বলেন, পাঠশালা ব্যবস্থা দেশে অনেক আগেই গড়ে উঠেছিল। এখান থেকেই শিশুরা প্রথম পাঠ সম্পন্ন করতো। কালের বিবর্তনে এই শিক্ষা ব্যবস্থা এখন বিলুপ্ত প্রায়। কোথাও কোথাও এটি টিকে রয়েছে। প্রথম শিক্ষা শুরু করা, ঝরে পড়া বা বিভিন্ন কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, এমন শিশুরা পাঠশালায় যাচ্ছে। পাঠশালা তাদেরকে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। পরে তাদের উপযোগী করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। এসব কারণে টিকে থাকা পাঠশালাগুলোকে সহায়তা করা হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
সূত্র : বাসস
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।