আমেরিকান কূটনীতিকরা জামায়াতকে কখনো গণতান্ত্রিক দল বলেনি - দৈনিকশিক্ষা

আমেরিকান কূটনীতিকরা জামায়াতকে কখনো গণতান্ত্রিক দল বলেনি

মিজানুর রহমান খান |

১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর [তারবার্তা নম্বর ৫৮৪৩] স্পিভাক ওয়াশিংটনকে জানান, ‘ঢাকার প্রেস এবং জনগণ সার্বক্ষণিক এই চিন্তায় আছেন যে, “বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য” করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেলের বরাতে বলা হয়েছে, জেনারেল ফরমান আলী এবং অন্যরা ১৫-১৬ ডিসেম্বরে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের তালিকা তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।’ আরেকটি নথিতে আছে, কেলি নামে ঢাকায় ইউনিসেফের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনের জে এন দীক্ষিত (পরে পররাষ্ট্রসচিব) কেলিকে একান্তে বলেছেন, ভারতীয়রা ফরমান আলীর দপ্তর থেকে কিছু নথিপত্র পেয়েছেন, যা থেকে অনুমান করা চলে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা ছিল।

১৯৭১ সালের ২৮ জানুয়ারি ওয়াশিংটন থেকে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম পি. রজার্স ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটে পাঠানো এক তারবার্তায় [নম্বর ১৬৮৯২] বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য জানতে মার্কিন কংগ্রেস অব্যাহতভাবে আগ্রহ দেখিয়ে চলেছে। তাই ডিসেম্বরের গোড়ায় যেসব বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন, তাঁদের নাম এবং নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপট জানিয়ে অতিরিক্ত তথ্য জানতে চাইছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।

তাই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের কাছে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে বলেও প্রতীয়মান হয়। ধারণা করা যায় যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর হার্বার্ট স্পিভাক ৫৭৭২ নম্বর কনফিডেনশিয়াল তারবার্তায় ওয়াশিংটনকে জানিয়ে দেন যে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য মুক্তিবাহিনীকে দায়ী করা নিম্নোক্ত কারণে সন্দেহ সৃষ্টি করে:
(১) আমাদের জানামতে, ১৪-১৫ ডিসেম্বরে (আগের [তারবার্তায়] এই তারিখ ১৫-১৬ ডিসেম্বর উল্লেখ করা হয়েছিল) হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই সময়ে পাকিস্তানি আর্মির নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং কারফিউ পুরোপুরি কার্যকর ছিল। (২) ওই সময়ে মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় থাকার ব্যাপারে সামান্যই সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে। (৩) নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো, তাঁদের কেউ ‘কোলাবরেটর’ ছিলেন না। বরং তাঁদের অধিকাংশই বাঙালি জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ...যদিও তাঁদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করেছেন কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য দেননি।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আটজনের মৃত্যু স্পিভাক নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। তাঁরা হলেন: অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক এম এফ রাব্বী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, এস এ মান্নান, নিজামউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক এ খায়ের ও ড. আলীম চৌধুরী।

‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা’ শীর্ষক ওই তারবার্তায় [৫৭৭২] আরও তিনটি বার্তার [ঢাকা ৫৭২৪ ও ৫৭৪৩: ইসলামাবাদ ১২৮৫৬] উল্লেখ দেখেছি। মনে হচ্ছে, ওই বার্তাগুলো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডবিষয়ক, এগুলোর হদিস আমি পাইনি।

১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি স্পিভাক অপর এক তারবার্তায় (ঢাকা ৩৯৩) যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বুদ্ধিজীবী হত্যার তথ্য উল্লেখ করেন। অন্যান্য বড় শহর থেকেও একই ধরনের খবর এসেছে, তবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তালিকার সবাই বাঙালি কিন্তু সাধারণভাবে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়। তাঁদের অধিকাংশই ১১ ডিসেম্বরের রাত এবং ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রায়ই উর্দি পরিহিত সামরিক জওয়ানদের পরিহিত থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা তাঁদের আটক করে। সংবাদপত্র, কনস্যুলেটের স্থানীয় স্টাফ এবং আমেরিকান সংবাদদাতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাংশের একটি ইট কারখানায় তাঁদের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়। মার্কিন সাংবাদিকেরা প্রায় ২০টি লাশ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁরা বলেছেন, মৃত্যুর আগে তাঁদের ওপর নির্যাতন চলেছে। ইউসিসের স্থানীয় জ্যেষ্ঠ স্টাফদের রিপোর্ট করেছেন যে ইতিপূর্বে গণনায় ধরা হয়নি এমন অনেক নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীকে মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল এবং তাঁদের হত্যা করা হয়। এই তারবার্তাটির পরের অংশ আমি পাইনি।

মার্কিন কংগ্রেস যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একাত্তরেই অবহিত ছিল তার সাক্ষ্য দেবে মার্কিন কংগ্রেশনাল রেকর্ড। উপরন্তু ওই সময়ে জাতিসংঘও স্বীকার করেছে যে একাত্তরের ডিসেম্বরের পরিস্থিতি মার্কিন কনস্যুলেটই সবচেয়ে ভালোভাবে নজরদারি করতে পেরেছে।

১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে উইলিয়াম বি. স্যাক্সবি মার্চের গণহত্যা সম্পর্কে ঢাকার ইউএসএইডে কর্মরত এক মার্কিন চিকিত্সকের একটি চিঠি উপস্থাপন করেন। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ ওহাইও থেকে ডা. জন ই রোড লিখেছেন, প্রিয় সিনেটর স্যাক্সবি, আমি ও আমার স্ত্রী কদিন আগে ঢাকা থেকে এসেছি। ...এই অধ্যাপকদের অনেকের পরিবারের সদস্যদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ড. রোড আর্চার ব্লাডের বার্তাগুলোর কথাও উল্লেখ করেন।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর পপুলেশন স্টাডিজের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. রিচার্ড ডি ট্যাবরস ও তাঁর স্ত্রী প্যাটন ও ট্যাবরস ১৯৭১ সালের ১৬ মে বোস্টন গ্লোবে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপকদের তাঁদের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়...’ [১৮ মে, ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড সিনেট, পৃ. ১৫৪৮৪]।

এখানে লক্ষণীয় যে, ’৫৬ সালে বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রতি মওদুদীর ঘৃণা কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় ছিল না। পাঞ্জাবিদের কব্জায় থাকা আর্মি চিন্তায়ও তা ছিল। মওদুদী একে ইসলাম দিয়ে ব্যাখ্যা করে আরও ভয়ংকর করে তুলেছিলেন।

সে কারণে একাত্তরের ২৯ মার্চ ব্যাংকক ডেটলাইনে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ সেলিন এস. হ্যারিসন লিখেছেন, ‘পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র যখন সমরাস্ত্র সরবরাহ শুরু করে তখন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে ঘরোয়াভাবে সতর্ক করেছিলেন যে এসব অস্ত্র একদিন বাঙালির আকাঙ্ক্ষা দমনেই ব্যবহূত হবে।’

১৯৭১ সালের ১৮ মে মার্কিন কংগ্রেসের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বাঙালি হত্যায় মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে হ্যারিসনের ওই প্রতিবেদনটির বরাত দিয়েছিলেন সিনেটর চার্চ (সূত্র: মে ১৮, ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড সিনেট, পৃ. ১৫৪৬৯) একই দিনে কংগ্রেস নথিবদ্ধ করে ১৬ মে ১৯৭১ ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউনের নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত লেখা, ‘সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তাড়া করেছে এবং ঠান্ডা মাথায় তাদের এবং তাদের পরিবারকে হত্যা করেছে’ (১৮ মে, ৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড পৃ. ১৫৬০৯)।

৭ জুন ১৯৭১, নিউইয়র্ক টাইমস-এ অ্যান্থনি লিউস (Anthony Lewis) লিখেছেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ “সিলেকটিভ”। আর্মির নির্দিষ্ট টার্গেট হলো বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের জনমত গঠনকারী অংশ—চিকিত্সক, অধ্যাপক, ছাত্র ও লেখক’ [১১ জুন, ১৯৭১, মার্কিন কংগ্রেসের বিতর্ক, পৃ. ১৯৫১৭]।

১০ জুন ১৯৭১ সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির শুনানিতে অনর্গল বাংলা বলতে পারা হার্ভার্ডের মেডিকেল স্কুল স্নাতক ড. জন রোড, যিনি এর আগে সিনেটর স্যাক্সবিকে চিঠি লেখেন, তিনি এ দিন শুনানিতে অংশ নেন। তিনি বলেন, আমি ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার রাস্তায় ট্যাংকবহরে আমেরিকান এম-২৪ প্যাটনস দেখেছি। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান আর্মির সামরিক আইন নম্বর ১৪৮ আমাকে ১৯৩০-এর দশকে নািস জার্মানির ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার’ ফরমান স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মে নিউইয়র্ক টাইমস-এ সিডনি এইচ শ্যানবার্গ দিল্লি ডেটলাইনে লিখেছেন, ‘রক্তস্নাত প্রতিশোধের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন তরুণ, বুদ্ধিজীবী, নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সংখ্যালঘু হিন্দু’ [সূত্র: ৮ জুলাই, ১৯৭১, রেকর্ড, পৃ. ২৪০৬৭]।

হিন্দু নিশ্চিহ্নকরণের যে যৌক্তিকতা দিয়েছেন জেনারেল টিক্কা খান তারও মূলে রয়েছে ওই জামায়াতবাদ বা জামায়াতিজম। মার্কিন কংগ্রেস অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সানডে টাইমস-এ লেখা একটি প্রতিবেদন বিবেচনায় নেয়। সেখানে মাসকারেনহাস লিখেছেন, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ আমি রেডিওতে টিক্কার কণ্ঠ শুনলাম ‘পাকিস্তান সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠের কণ্ঠস্বর আসলে সহিংস ও উচ্চকিত সংখ্যালঘুদের কারণেই চাপা পড়েছে, তারাই আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের পথে যেতে বাধ্য করেছে [সানডে টাইমস, লন্ডন, ১৩ জুন, ৭১ মাসকারেনহাস [কংগ্রেশনাল রেকর্ড জুলাই ৮, ৭১, পৃ. ২৪০৭৯]। নবম ডিভিশনের দপ্তরে কর্নেল নাজিম তাঁকে বলেন, ‘হিন্দুরা তাদের অর্থ দিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে একেবারে নত করে ফেলেছে। ...বাঙালি সংস্কৃতি মানে হিন্দু সংস্কৃতি।’

মাসকারেনহাস লেখেন, টিক্কা খান ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে আমাকে বলেন, তিনটি নীতি বাস্তবায়ন করছেন তিনি। ১. বাঙালিরা ‘অবিশ্বস্ত’ তাই পশ্চিম পাকিস্তানিরাই তাদের শাসন করবে ২. বাঙালিদের ইসলামীকরণ করতে হবে ৩. হিন্দু নিধন ও নির্মূলের পর তাদের সম্পদ দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। ...ইয়াহিয়া ও টিক্কা তাদের এ রকম কর্মসূচির প্রতি এ পর্যন্ত বাঙালি আইনজীবী মৌলভি ফরিদ আহমেদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর প্রফেসর গোলাম আযমের সমর্থন পেয়েছেন [জুলাই ৮, ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড, পৃ. ২৪০৯৯]।

১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই সিডনি এইচ শ্যানবার্গ নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, সেনাবাহিনীর সৃষ্টি করা শান্তি কমিটিকে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের অনুগত ও সহায়তাকারী হিসেবে পরিচিত মুসলিম লিগ ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ডানপন্থী ধর্মীয় দলের অনুসারীরা রয়েছে (১৪ জুলাই, ১৯৭১ কংগ্রেশনাল রেকর্ড, পৃ.৩)। এর মাত্র ১২ দিন পর ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসে শুনানিতে পেশ করা হয়েছিল কেবল শান্তি কমিটির ওপর তৈরি একটি বিশেষ প্রতিবেদন। ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত লি লেসকেজের তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শান্তি কমিটির সদস্যরা বাস্তবে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ছিল। কাউকে গ্রেপ্তার বা হত্যা করতে তাদের তরফে সেনাবাহিনীর কাছে একটি শব্দ উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল (২৬ জুলাই ১৯৭১, কংগ্রেশনাল রেকর্ড, পৃ. ২৭১৩৪)। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তারা তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, গোলাম আযম শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।

আমি আমার অনুসন্ধানে দেখেছি, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মি ও জামায়াতইজমের কোনো অমিল নেই। বরং জামায়াতই বুদ্ধিজীবী নিধনকে ইসলামের দোহাই দিয়ে একে প্রকারান্তরে ধর্মযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। বাঙালি মুসলমানের বর্ণ, গোত্র ও রক্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টিকে ধর্মের বাতাবরণে যথার্থতা দিয়ে জামায়াত মুসলিম সভ্যতাকেই কলঙ্কিত করেছে।

পাকিস্তানি লেখক হুসেইন হাক্কানিও ভালি নসরকে সমর্থন করেছেন। হাক্কানি তাঁর পাকিস্তান: বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি গ্রন্থে লিখেছেন, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের অবাঙালি বেসামরিক নাগরিক ও পাকিস্তানপন্থী ইসলামি গ্রুপগুলোর মধ্য থেকে এক লাখ রাজাকার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী বিশেষ করে তার ছাত্র শাখা ইসলামি জমিয়ত-ই-তালাবা (আইজেটি) দুটি আধা সামরিক কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ইউনিট গঠনে সামরিক বাহিনীর প্রচেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। আইজেটি বিপুলসংখ্যক ব্যক্তির নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার রাজাকারের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সেক্যুলার রাজনীতিকেরা অভিযোগ করেছিলেন যে এটা হলো ‘অ্যান আর্মি অব জামায়াতে ইসলামি নমিনিজ।’ ইসলামি ক্যাডারদের দুটি স্পেশাল ব্রিগেডের নামকরণ করা হয় আলশামস (আরবিতে সূর্য) এবং আলবদর (চন্দ্র)। পরে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি রাজাকারদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে: একটি পৃথক রাজাকার ডাইরেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল...দুটি পৃথক শাখার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। আলবদরকে স্পেশালাইজড অপারেশনস বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।

সিনডি সি. কম্বস ও মার্টিন স্ট্যান্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব টেররিজম বইয়ে লিখেছেন ১০ হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে হত্যার সঙ্গে আলবদরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।

১৯৭১ সালের মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির শুনানিতে বুদ্ধিজীবী হত্যা প্রসঙ্গটি আসে। বলা হয়, ‘পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, প্রফেসরস, আর্মি অফিসারস, ইঞ্জিনিয়ারস, ডাক্তার ও সম্ভাবনাময় অন্য যে কেউ’ (পৃ. ১১৭)। এর ৩১২ পৃষ্ঠায় আছে, East Pakistanis accuse the West Pakistan Army of genocide—of the selected killing of Bengali intellectuals and of perpetuating a reign of terror so that they will be unable to raise effective opposition for many years to come. সিডনি শ্যানবার্গের ২৩ সেপ্টেম্বরের নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এই রিপোর্টও জুডিশিয়ারি কমিটি বিবেচনায় নিয়েছে, যেখানে তিনি বলেন, ‘Moslem League and Jamaat-i-Islami, which have usually backed the military regime.’
ভালি নসর ১৯৯৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত মাওলানা মওদুদীর ওপর একটি বইয়ে মওদুদীকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি [Mawdudi and the Making of Islamic Revivalism/Seyyed Vali Reza Nasr লিখেছেন, His discourse on the Islamic state deliberately sidestepped the ulama, depicting them as an anachronistic institution that had no place in a reformed and rationalized Islamic order.

কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে প্রফেসর ক্রিশ্চিয়ান গারলেক উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় আলবদর জড়িত। তিনি যদিও মনে করেন পাকিস্তানি আর্মি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সিস্টেমেটিক এক্সটারমিনেশন বা পদ্ধতিগত বিনাশ ঘটায়নি। কিন্তু তিনিও তাঁর বইয়ের ১৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, একাত্তরের ডিসেম্বরে ঢাকা, খুলনা, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৮০ জন পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং সিভিল সার্ভেন্টদের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় যারা ঘটিয়েছে, তারা হলো প্যারা মিলিটারি আলবদর।

ডেভিড লিউস লিখেছেন, বাঙালি ‘রেসকে’ দুর্বল করতে ধর্ষণকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। মাসকারেনহাস দি রেপ অব বাংলাদেশ বইয়ে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোতে শেল ছুড়েছিল। কারণ, সেগুলো ‘হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের সংকটকে ‘কতিপয় বুদ্ধিজীবীর’ সৃষ্ট সমস্যা হিসেবে দেখেন (পৃ. ৭০)। টিক্কা খান ‘কেবল ৩৫ হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবী’ হত্যার কথা স্বীকার করেন (পৃ. ৭২)।

ইমন মারফি জামায়াতে ইসলামী (পৃ. ৭২)-এর পক্ষে সেনাবাহিনী, বিশেষ করে আইএসআইর সঙ্গে জোট বাঁধে এবং ‘ইসলামের শত্রু’ নিধনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে বলে উল্লেখ করেন।

মাসকারেনহাস তাঁর বইয়ের ২৫৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৫ মার্চের পর দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত গণহত্যার ক্যাম্পেইন চলে। এর লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাঙালি বুদ্ধিজীবী।’

মার্কিন দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক টার্গেট করেছিল। কারণ, জামায়াত ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে ধর্মবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৭০ সালের জুনে ঢাকায় শেখ মুজিব মার্কিন কূটনীতিক কিলগোরের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে জামায়াতের কাছ থেকে তিনি মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন (সূত্র: দি আমেরিকান পেপারস, ইউপিএল, ১৯৯৯, পৃ. ৩৬৭)।

আমেরিকান কূটনীতিকেরা জামায়াতকে কখনো গণতান্ত্রিক দল বলেনি। ১৯৭০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এক মার্কিন নথিতে জামায়াতকে ‘ভোসিফেরাস এবং ফেনাটিক’ এবং ১৯৭০ সালের ২২ জুন লাহোর থেকে পাঠানো অপর এক নথিতে জামায়াতকে ‘রাইটিস্ট এক্সট্রিমিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন পিটার ডি কনস্টেবল।
মার্কিন ডকুমেন্টস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে বাঙালির বর্ণ ও গোত্রকে নিচু হিসেবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি ১৯৫৬ সালে মওদুদী তাঁর প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরে পরে দেখিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক এবং রবার্ট জে কার্লের সঙ্গে আলোচনা করেন। ক্যান্টনমেন্টে ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে এই বৈঠক হয়। এতে বাঙালিদের সম্পর্কে নিয়াজি যা বলেছেন, তার সত্যতা আবারও নিশ্চিত করেছেন প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) খাদিম হোসেন রাজা। A Stranger in My Own Country: East Pakistan, 1969-1971 (OUP, 2012)। ২০১২ সালে রাজার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত বইয়ে তিনি বলেন, নিয়াজি যে উক্তি করেছিলেন তা উচ্চারণে চেঙ্গিস খানও বিব্রত হতেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ পদাতিক ডিভিশনের সাবেক জিওসি নিয়াজির ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’ সম্পর্কে উল্লেখ করেন যে যব he would let loose his soldiers on the women of East Pakistan till the lineage/ethnicity of the Bengali race was changed.

৪ আগস্ট ১৯৭১ নিয়াজির সঙ্গে আলোচনার পর ওয়াশিংটনকে স্পিভাক লেখেন, ‘বাঙালিদের প্রতি জেনারেলের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই অবমাননাকর। ম্যাকুলেকে বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাঙালি মিথ্যুক, চোর, বিশ্বাসঘাতক এবং পেছন থেকে ছুরি মারা লোক। নিয়াজি লর্ড কার্জনের বরাতে বলেন, বেঙ্গল সব সময় নিচু ভূমির দেশ, এখানে নিচু জাতের ও মিথ্যুকরা বাস করে। জেনারেল তাঁর আলোচনায় কখনোই তাঁর মিশনের রাজনৈতিক তাত্পর্য সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।’

কিন্তু মওদুদীই সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৫৬ সালে লিখেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নোংরা। এর শিকড় গভীরে প্রোথিত করার জন্য জামায়াতের ছত্রচ্ছায়ায় আলবদর বাহিনী তাই বুদ্ধিজীবীদেরই টার্গেট করেছিল। আমেরিকার কংগ্রেসের একটি সাম্প্রতিক শুনানির জন্য প্রস্তুত একটি গবেষণাপত্রেও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে আলবদরকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।

চলবে ...

ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে : শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে : শিক্ষামন্ত্রী ডিবির হাতে গ্রেফতার নাসিরই চালান শিক্ষার ঢাকা ডিডি অফিস! - dainik shiksha ডিবির হাতে গ্রেফতার নাসিরই চালান শিক্ষার ঢাকা ডিডি অফিস! শিক্ষাভবন যখন কর্মকর্তার নোট-গাইড বিক্রির দোকান - dainik shiksha শিক্ষাভবন যখন কর্মকর্তার নোট-গাইড বিক্রির দোকান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষমতা পেলো কারিগরি বোর্ড - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষমতা পেলো কারিগরি বোর্ড পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত সুপারিশ আগস্টে - dainik shiksha পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত সুপারিশ আগস্টে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে বুদ্ধিজীবী হ*ত্যায় জামায়াত কীভাবে জড়িত - dainik shiksha বুদ্ধিজীবী হ*ত্যায় জামায়াত কীভাবে জড়িত please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062830448150635