আর্থিক দুরবস্থায়ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিচ্ছেন পাকিস্তানের অভিজাতরা - দৈনিকশিক্ষা

আর্থিক দুরবস্থায়ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিচ্ছেন পাকিস্তানের অভিজাতরা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

পাকিস্তানে শাসন ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা অভিজাতরা প্রতি বছর সেখানে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন কমপক্ষে ১৭ বিলিয়ন (১ হাজার ৭০০ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ। দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও এ সুযোগ-সুবিধা নেয়া বন্ধ করছেন না তারা। এতে করে দেশটির আর্থিক বিপত্তির মাত্রা আরো ঘনীভূত হয়ে উঠছে। সামরিক-বেসামরিক অভিজাততন্ত্র এভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ বন্ধ না করলে দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গৃহীত সব ধরনের পদক্ষেপই ব্যর্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পাকিস্তানের এ অভিজাত শ্রেণী গড়ে উঠেছে প্রধানত দেশটির সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, বৃহদায়তনের ভূমি মালিক ও করপোরেট শিল্পপতিদের নিয়ে। স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন পর্যন্ত এ অভিজাতরাই পাকিস্তানে কর ব্যবস্থায় সংস্কার এবং শিক্ষা, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমে বিনিয়োগ অথবা রফতানিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে গৃহীত সব ধরনের উদ্যোগের বিরোধিতা করে এসেছেন। এতে দেশটির অর্থনীতিও দশকের পর দশক পার করেছে স্থবিরতার মধ্য দিয়ে। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে পাওয়া উন্নত বিশ্বের ঋণ ও অনুদান দেশটির অর্থনীতিকে বহুবার বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান পশ্চিমা ব্লকের কাছে দেশটির গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। একই সঙ্গে দেশটির অভিজাতদের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের অভিজাতরা প্রতি বছর রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছেন ১৭ বিলিয়ন (১ হাজার ৭০০ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ। এ সুবিধাভোগীদের মধ্যে আছেন রিয়েল এস্টেট খাতের বড় ব্যবসায়ী, সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও শিল্পমালিকরা। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও অভিজাতরা এখনো এসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যাচ্ছেন। বরং গত দুই বছরে এর পরিমাণ আগের চেয়েও বেড়েছে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নানা নিবন্ধ ও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে লাহোরভিত্তিক দ্য ফ্রাইডে টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সাপ্তাহিক সংবাদমাধ্যমটির সম্পাদক রাজা রুমি বলেন, করছাড়, সস্তায় কাঁচামাল ক্রয়ের সুযোগ, বাড়তি মূল্যে পণ্য বিক্রি, মূলধন-ভূমি-সেবা খাত এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার হিসেবে নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন অভিজাতরা। এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেশটির বাজার ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশকে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে গন্তব্য ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে আকর্ষণও হারিয়েছে পাকিস্তান।

পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হলো দেশটির করপোরেট খাত। প্রতি বছর খাতটিকে দেয়া রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ ৪৭০ কোটি ডলারের সমান। এর পরেই আছে দেশটির সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ, যারা পাকিস্তানের মোট আয়ের প্রায় ৯ শতাংশের মালিক। দেশটির মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১ শতাংশ ভূমি মালিক সামন্ত। পাকিস্তানের মোট আবাদযোগ্য জমির ২২ শতাংশই তাদের কুক্ষিগত।

এ ভূমি মালিক সামন্তরা দেশটির পার্লামেন্টে বরাবরই জোর উপস্থিতি ধরে রেখেছে। যেকোনো নির্বাচনের সময় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ সামন্তদের নির্দিষ্ট একটি অংশ থেকে প্রার্থী নির্বাচন করে থাকে। ভূমির মালিকানা, মূলধনে প্রবেশাধিকার ও গোষ্ঠীভিত্তিক নেটওয়ার্কই দেশটির নির্বাচনে জয়-বিজয় নির্ধারণ করে থাকে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিষয়টি সবচেয়ে প্রকট বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।

দেশটির সামরিক বাহিনীসংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছরই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ পেয়ে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় মাত্রায় করছাড়ও দেয়া হয়। এছাড়া বাজার, আবাসিক ভূমি ও অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রবেশের সুবিধাও পেয়ে থাকে তারা। সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যত ওপরে উঠতে থাকেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের মাত্রাও তত বাড়তে থাকে। চাকরিতে থাকাকালে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আবাসিক প্লট ও বাণিজ্যিক জমিও বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। আবার বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর পেনশনের পাশাপাশি উচ্চবেতনের করপোরেট চাকরির সুবিধাও রয়েছে তাদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের এসব অভিজাতরা রাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় যেসব করছাড়, ভর্তুকি ও নীতিগত ছাড়ের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, সেগুলো ত্যাগ করতে না পারলে দেশটির ক্রমবর্ধমান সরকারি ব্যয় বা বাজেট ঘাটতিকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। দশকের পর দশক ধরে দেশটির সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনীতিবিদরা বরাবরই জনসাধারণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িয়ে হলেও নিজেদের সুরক্ষিত রেখে এসেছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটিও জনগণের কাছ থেকে নেয়া পরোক্ষ করেই কেন্দ্রীভূত। সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়াতে পার্লামেন্টে গৃহীত সর্বশেষ প্রস্তাবটিতে এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। পার্লামেন্টের ওই প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশটির সরকার রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি রুপি। এটি আদায় করা হবে প্রধানত বর্ধিত বিক্রয় কর ও আবগারি শুল্কের মতো করের পরোক্ষ উৎস থেকে।

আবার দেশটিতে বিদ্যুৎ খাতের সার্কুলার ডেবট নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানো হলেও এর ভারও গিয়ে পড়ছে প্রধানত জনসাধারণের ওপরই। পাকিস্তানে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে গত কয়েক মাসে রুপির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। এ অবমূল্যায়ন ও জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে এখন দেখা হচ্ছে দেশটিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির প্রধানতম কারণগুলোর অন্যতম হিসেবে।

সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের একই সময়ের তুলনায় ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আবার এর সঙ্গে সঙ্গে আমদানি বাড়লেও বাড়ানো যায়নি রফতানির পরিমাণ। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও বেড়েছে। দেশটির ঋণ, বাণিজ্য ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির এ সমস্যাকে দীর্ঘদিনের সুশাসন ঘাটতির ফলাফল হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির সরকারগুলো কখনই দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার ওপর মনোযোগ দেয়নি। এর পরিবর্তে তারা শাসনক্ষমতার কাছাকাছি থাকা অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধিতেই মনোযোগ দিয়েছে বেশি। জনগণের করের টাকায় সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন অভিজাতরা।

পাকিস্তানে এখন রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেশটিতে সর্বোচ্চ ১৮ দিনের আমদানি চালু রাখা সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। এ মুহূর্তে আইএমএফের ঋণকেই পাকিস্তানের অর্থনীতির একমাত্র লাইফলাইন হিসেবে দেখছেন তারা। তবে শাসনক্ষমতার কাছাকাছি থাকা স্থানীয় অভিজাতরা রাষ্ট্র থেকে সুযোগ সুবিধা নেয়া বন্ধ না করলে দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা তাদের।

পাকিস্তানের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক এরই মধ্যে দেশটিকে দেউলিয়া বলতেও শুরু করে দিয়েছেন। দেশটির ওপর বিদেশী দেনা পরিশোধের চাপ এখন বিদ্যমান রিজার্ভের কয়েক গুণ। চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগেই অন্তত ২০ বিলিয়ন (২ হাজার কোটি) ডলার পরিশোধ করতে হবে পাকিস্তানকে। আইএমএফের কাছ থেকে পাওয়া ঋণের কিস্তি এ অর্থ পরিশোধে পর্যাপ্ত না হলেও তা পাকিস্তানের জন্য আপাতত অন্যান্য দেশের কাছ থেকে নতুন করে ঋণগ্রহণের রাস্তা খুলে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এর পরও দেশটিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার বড় আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন তারা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ৭০০ কোটি ডলারের প্যাকেজটির অর্থ ছাড় হবে কয়েক কিস্তিতে। যদিও দেশটির অভিজাতরাই রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেয় এর কয়েক গুণ বেশি। এর সঙ্গে সঙ্গে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ, পণ্য আমদানির চাপও রয়েছে। সব মিলিয়ে অভিজাতরা তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলোর বাইরে আসতে না পারলে দেশটির পক্ষে বর্তমান সংকট মোকাবেলা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিবেশ এখনও হয়নি: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পরিবেশ এখনও হয়নি: শিক্ষামন্ত্রী দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে : সেনাপ্রধান - dainik shiksha দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে : সেনাপ্রধান তিন-চার দিনের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী - dainik shiksha তিন-চার দিনের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেসবুক-টিকটক আপাতত বন্ধ থাকছে - dainik shiksha ফেসবুক-টিকটক আপাতত বন্ধ থাকছে পিএসসির সব পরীক্ষা ৩১ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত - dainik shiksha পিএসসির সব পরীক্ষা ৩১ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সবার কাছে নাশকতার ছবি-ভিডিয়ো ফুটেজ চেয়েছে পুলিশ - dainik shiksha সবার কাছে নাশকতার ছবি-ভিডিয়ো ফুটেজ চেয়েছে পুলিশ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064349174499512