আলোকিত মানুষ ড. ওয়াজেদ মিয়া - দৈনিকশিক্ষা

আলোকিত মানুষ ড. ওয়াজেদ মিয়া

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা পদার্থ বিজ্ঞানী। তার ডাক নাম সুধা মিয়া। তবে পরমাণু বিজ্ঞানী নামেই দেশবাসির কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন। বিশ্ববরেণ্য এ পরমাণু বিজ্ঞানী ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘী ফতেহপুর গ্রামের মিয়া বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আব্দুল কাদের মিয়া এবং মাতার নাম ময়জুন্নেছা। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। নিজ গ্রামে অবস্থিত চরকরিম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ডিসটিংশনসহ প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান নিয়ে আইএসসি এবং ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় এবং ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৬২-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। কমিশনের কর্মে নিয়োজিত থাকাকালে স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদশের্র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ ছিলো আন্দোলনমুখর এক অগ্নিগর্ভের বছর। এ সময়ে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন সংগঠিত হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার শিক্ষা কার্যক্রম অভিজাত শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত করে এক রিপোর্ট পেশ করে। শিক্ষাকে লাভজনক করার উদ্দেশে একটি অবাস্তব শিক্ষা কমিশন ঘোষণা করলে বাঙালিরা একটি বাস্তবধর্মী সর্বজনীন মৌলিক শিক্ষা ব্যবস্থা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগঠিত করে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেফতার হন এম এ ওয়াজেদ মিয়াসহ অনেকে। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাবরণ করেন। শিক্ষা কমিশন ও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে জোরদার হতে থাকে। জেনারেল আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। ওই আন্দোলনে গ্রেফতার হওয়ার ১১ দিন পর ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসেন তার বন্ধু আঞ্জুমান। 

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরলে ঢাকার আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাকে অ্যাসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এ সুবাদে তিনি ১৯৬৯, ১৯৭৩ ও ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ওই গবেষণা কেন্দ্রে ছয় মাস করে কয়েকবার গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে তিনি পোস্ট ডক্টোরাল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতেও পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ইতালির ট্রিয়েস্টস্থ আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান কেন্দ্রে ছয় মাস গবেষণাকর্ম শেষে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসেন। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শেষের দিকে তিনি আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। 

১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ। ছয় দফা আন্দোলনের কারণে গোটা দেশে তখন ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে । এ রকম পরিস্থিতিতে রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমানের সহায়তায় ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর পবিত্র শবেবরাতের রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দের পাত্র ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাবা শেখ মুজিব জেলে থাকায় তাদের বিয়ের আয়োজনটি ছিলো খুবই সাদামাটা। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হয় ‘শেখ মুজিবের জেষ্ঠ্য তনয়া শেখ হাসিনার বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় নিরানন্দ ও আলোকসজ্জাবিহীন পরিবেশে। বিয়ের পরদিন জেলগেটে ওয়াজেদ-হাসিনা দম্পতিকে দোয়া করেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি ও কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব। নতুন জামাইকে সে সময় তিনি একটি রোলেক্স ঘড়ি উপহার দেন। এই উপহার আজীবন সযত্নে রেখেছিলেন ড. ওয়াজেদ মিয়া। 

এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্নাতক পর্যায়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থদ্বয়ের নাম Fundamentals of Thermodynamics (University Press, Dhaka, 1988) Ges Fundamentals of Electromagnatics (Tata-Mcgraw-Hill, 1982)। রাজনীতি নিয়েও তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। তার অন্যতম গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ যা ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। 

বাংলাদেশের রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রাণপুরুষ এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ বিজ্ঞানাগার, ‘এম এ ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নাটোরে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রংপুরে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তার নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বিশ্বমাঝে বাংলাদেশ বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে। 

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এর আগে ও পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার উপস্থিতি ছিলো উল্লেখযোগ্য। তিনি সর্বদা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ড. ওয়াজেদ মিয়াকে বিজ্ঞানী হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। রাজনীতিতে তাকে কখনোই জড়ানোর চেষ্টা করেননি। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের সময় ড. ওয়াজেদ মিয়া জার্মানিতে ছিলেন। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবস্থান করায় তারা দুজন প্রাণে বেঁচে যান। মূলত পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বিশেষ আমন্ত্রণে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ তার ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলকে নিয়ে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ আগস্ট জার্মানির রাজধানী বন সফরে যান। 

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া রচিত বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ এ তখনকার ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা হলো-‘১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট দিনটি ছিলো শুক্রবার। বেলজিয়ামে তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে ভোর ৬টার দিকে ওয়াজেদ মিয়ার ঘুম ভাঙে। কারণ, জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী টেলিফোনে জরুরি কথা বলতে চান। ঘুম থেকে উঠে ওয়াজেদ মিয়া তার স্ত্রী শেখ হাসিনাকে মি. চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার জন্য টেলিফোন সেটের কাছে পাঠান। ফোনের রিসিভার ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘আজ ভোরে বাংলাদেশে সামরিক ক্যু হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এখনই আপনারা আমার এখানে জার্মানিতে চলে আসুন।’ 

শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা- দুজনই কাঁদতে কাঁদতে বলেন যে নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ আছে যেটি ওয়াজেদ মিয়া তাদের বলতে চাইছেন না। আর তখন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বলেন, প্যারিসের যাত্রা বাতিল করার কারণ পরিষ্কারভাবে না বললে তারা সে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। বাধ্য হয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন যে বাংলাদেশে ‘কী একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। এ কথা শুনে তারা দুই বোন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙে যায়।’ সকালে তারা বেলজিয়াম ছেড়ে জার্মানির বনের উদ্দেশে রওনা হন। বিকেলে তারা রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে পৌঁছান। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়া সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাঙ্কফুর্টে যাত্রাবিরতি করেন এবং পরে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় যান।

ড. কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী-এ তিন জন মিলে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। তখন ড্রইং রুমে বসে ড. কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং ওয়াজেদ মিয়া উৎকণ্ঠিত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এরই এক ফাঁকে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে কোনো কিছু জানানো হবে না, এই শর্তে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ‘বিবিসির এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকায় ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এক বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।’

এমন অবস্থায় মি. চৌধুরী (যিনি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছিলেন) মনে করেছিলেন, একমাত্র ভারতে আশ্রয় নেয়াটা তাদের জন্য নিরাপদ হবে। ১৬ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী ওয়াজেদ মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যান। উদ্দেশ্য ছিলো ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের সেই কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী সেখান থেকে চলে আসেন। তখন ভারতীয় দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে রাষ্ট্রদূতের বাসায় নিয়ে যান। তখন জার্মানিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন একজন মুসলমান সাংবাদিক।

আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রদূত ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন যে ভারত সরকারের কাছে তারা ঠিক কী চান, সেটি লিখে দিতে। এ কথা বলে রাষ্ট্রদূত একটি সাদা কাগজ ও কলম এগিয়ে দেন ওয়াজেদ মিয়ার দিকে। সে কাগজে ওয়াজেদ মিয়া যা লিখেছিলেন সেটি ছিলো এ রকম ‘শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশুছেলে জয়, শিশুমেয়ে পুতুল এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় কামনা করি।’ সেই কঠিন সময়ে ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার হাতে কোনো টাকা ছিলো না। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দুজনই ২৫ ডলার সঙ্গে নিয়ে দেশ থেকে এসেছিলেন। রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাদের কোনো টাকা-পয়সা লাগবে কি না? শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে ওয়াজেদ মিয়া জানান, হাজার খানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই তারা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবেন।

এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে করে ২৫ আগস্ট সকালে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান জয় ও পুতুল। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর তাদের প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। ভারত সরকারের দুই কর্মকর্তা দুপুরের দিকে তাদের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যান নয়দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। 

ইতোমধ্যে ভারত সরকারের একজন যুগ্ম-সচিব শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়াকে জানান যে তাদের একটি বিশেষ বাসায় নেয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষাৎকারের জন্য। সেদিন রাতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় পৌঁছান। এর প্রায় ১০ মিনিট পর ইন্দিরা গান্ধী ওইকক্ষে প্রবেশ করে শেখ হাসিনার পাশে বসেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান, ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে তারা পুরোপুরি অবগত রয়েছেন কি না। জবাবে ওয়াজেদ মিয়া রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ পরিবেশিত এবং ঢাকায় ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত দুটো ভাষ্যের কথা উল্লেখ করেন। তখন ইন্দিরা গান্ধী সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তাকে ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য জানাতে বলেন। তখন ওই কর্মকর্তা ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। 

শেখ হাসিনাকে সান্ত্বনা দেয়ার সময় ইন্দিরা গান্ধী যে কথাগুলো বলেছিলেন সেটি ওয়াজেদ মিয়া তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘তুমি যা হারিয়েছো, তা আর কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এ ছাড়াও তোমার ছোট বোন ও তোমার স্বামী রয়েছে তোমার সঙ্গে। এখন তোমার ছেলেমেয়ে ও বোনকে মানুষ করার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে।’

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩ অক্টোবর ওয়াজেদ মিয়া ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনের অধীনে আণবিক খনিজ বিভাগে দিল্লি কেন্দ্রে যোগদান করেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ অক্টোবর সাময়িক ও দৈনিক ভিত্তিতে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশন থেকে ওয়াজেদ মিয়ার জন্য একটি পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের বন্দোবস্ত করা হয়। ওই ফেলোশিপের শর্তানুসারে বাসা ও অফিসে যাতায়াতের সুবিধাদির অতিরিক্ত দৈনিক ভাতা প্রদান করা হতো। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মোরারজী দেশাই ক্ষমতায় আসার পর অথাৎ ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার পরিবারের ওপর বিভিন্ন ধরনের চাপ ও হয়রানিমূলক কার্যক্রম শুরু হয়। এরই প্রেক্ষিতে ভারত সরকার ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মে ড. ওয়াজেদ মিয়াকে পরিবারসহ ঢাকা পাঠান। বাংলাদেশে ফিরে এসে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদান করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরমাণু কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরগ্রহণ করেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ’ গঠন করেন এবং ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ মে শনিবার দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর ৬৭ বছর বয়সে শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তাকে তার প্রিয় জন্মভূমি পীরগঞ্জে তার বাবা-মার কবরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। তিনি আমৃত্যু তার নিজের গড়া সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ’ এর সভাপতি ছিলেন।

জ্ঞানতাপস ড. ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭২ ও ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পরপর দুবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩-১৯৮৫, ১৯৮৯-১৯৯৭ পরপর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দুই বছর মেয়াদের জন্য একই সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পরপর তিন মেয়াদের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে '৯৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি পরপর দুটি মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুন সৌদি বাদশার অতিথি হিসেবে ড. ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী শেখ হাসিনা ও পুত্র জয়কে নিয়ে সৌদি আরব যান। 
তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এবং ঢাকার বৃহত্তম রংপুর কল্যাণ সমিতি, উত্তরবঙ্গ জনকল্যাণ সমিতি, রাজশাহী বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরাম, বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার মির্জাপুর বছির উদ্দিন মহাবিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। বর্ণাঢ্য শিক্ষা ও কর্মময় জীবনের অধিকারী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়া তার সমগ্র জীবনে মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। 

ড. ওয়াজেদ মিয়ার ক্ষমতার মোহ না থাকলেও তিনি রাজনীতি বিমুখ ছিলেন না। স্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সকল বাধাবিপত্তি জয় করে দেশে ফিরতে চাইলে তিনি তাতে সমর্থন ও পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। নিজের দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে আদর্শ শিক্ষা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। পরিশেষে ড. ওয়াজেদ মিয়া ব্যক্তিজীবনে যেমন একজন সফল ও আদর্শ মানুষ ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে স্বামী এবং পিতা হিসেবে সফল ছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে তার বরেণ্য কর্মকাণ্ড ও নির্মোহ জীবনযাপন জাতির কাছে অমর হয়ে থাকবে। আমি ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয় 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063900947570801