বাজেটে জনসাধারণের চোখ থাকে কোন পণ্যটির দাম বাড়বে আর কোনটির কমবে সেদিকে। আর ব্যবসায়ীদের চোখ একটা বাক্সের ভেতরে উঁকি দেয়। তারা জানতে চান কোথায় কোন ট্যাক্স-ট্যারিফ উঠে গেলো। তার জন্য কোন পণ্য সেবার ব্যবসা সহজ বা কঠিন হবে? কিংবা কোন পণ্য সেবার ভ্যাট ট্যাক্স কমলো-বাড়লো বলে সেটির লাভ লোকসানের হিসেব সহজ-কঠিন হলো। আর নতুন খাতের উদ্যোক্তারা অপেক্ষায় থাকেন, সরকার তাদের জন্য কি সুবিধা নিয়ে আসছে তার জন্য।
অতীতে এবং বর্তমানেও সরকার বিভিন্ন খাতকে প্রণোদনা, ট্যাক্স রিবেট কিংবা বিকল্প ও প্রতিযোগীপণ্যের অবাধ বাণিজ্য কিছুটা গরল (সরল নয়) করে দিয়ে কোনো বিশেষ খাতকে সুবিধায়িত করে থাকে। এর ফল হলো- একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে খাত বিকশিত হলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান তৈরি হয়, অন্যদিকে অর্থনীতিতে ওই খাতের অবদান বাড়ে। তবে সব সময় সব খাত সুবিধা পেয়ে সমানভাবে বিকশিত হয়- এমন নয়। একটি খাত বিকাশের জন্য রাজস্ব নীতি ছাড়াও আরো অন্যান্য পিলার থাকে। সেগুলো সমান্তরালে উন্নীত না করলে আশানুরূপ ফল নাও হতে পারে।
এবারের ২০২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দের বাজেটে ই-কমার্স নিয়ে ভুরি ভুরি কথা আছে। সত্যিকার অর্থে এই খাতকে বিশেষ খাত বানিয়ে সরকার একটি সেল গঠন করেছে, সেই সেল থেকে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে এই খাতের প্রতারণাকে ঠেকানো হয়েছে এবং একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করার মাধ্যমে একটি সমস্যার কিছুটা সমাধান করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের দাবিকৃত অর্থের যে অংশ তৃতীয় বা গেটওয়েতে আটকে ছিলো তা ফেরত দিতে পেরেছে। তিনশত ৯৭ কোটি টাকার মধ্যে তিনশত ৭৪ কোটি টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হয়েছে। পুরো ঘটনার কাছে এই অর্থ হয়তো বড়ো কোনো অংশ নয়। কিন্তু আদালত বা আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রক্রিয়ার বাইরে একটি কারিগরি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতারিত গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে হরহামেশা ঘটে না।
এবারের বাজেটে ই-কমার্স খাত থেকে ট্যাক্স ও ভ্যাট সংক্রান্ত আটটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ই-লার্নিং বা অনলাইন এডুকেশন এর উপর ভ্যাট প্রত্যাহারের পর আর কোনো শুভ সংবাদ এখানে পাননি উদ্যোক্তারা।
বলে রাখা ভালো, আমাদের যোগাযোগ ও ডিজিটাল অবকাঠামোর তুলনায় ই-কমার্স কাংখিত প্রবৃদ্ধির ধারায় নেই। এখনো সামগ্রিক খুচরা ব্যবসার এক শতাংশও অনলাইনে হয়না। প্রতিদিন এই সেবা নেন ছয় লাখের কিছু বেশি মানুষ, যেখানে ঢাকাতেই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করেন। তাই বাইরে থেকে যতোটা ঢাকঢোল আছে ভেতরে তা নয়। তবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এর অবদান সমানুপাতিক নয়, বরং বেশি বলা যায়। এ খাতে সরাসরি প্রায় সাড়ে তিন লাখ কর্মী কাজ করেন। কিন্তু অন্তত দুই লাখ তরুণ, গৃহিনী ও আবাসিক উদ্যোক্তা আছেন, যারা পূর্ণ ও খণ্ডকালীন সময় নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগ পরিচালনা করেন। মোট বাজারের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ এদের নিয়ন্ত্রণে।
বিগত বছরগুলোতে দাবি আদায় না হওয়াতে এ বছরও একই দাবি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন, ট্রেড লাইসেন্স অনুমোদন, ফুলফিলমেন্ট সেন্টারের উপর থেকে মূসক রেয়াত, উৎসে কর থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি।
‘এসআরও নং-১৮৬-আইন/২০১৯/৪৩-মূসক। তারিখ- ১৩ জুন, ২০১৯ অনুসারে – অনলাইনে পণ্য বিক্রয় অর্থ ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে সেই সকল পণ্য ও সেবার ক্রয়-বিক্রয়কে বুঝাবে যা ইতিপূর্বে কোনো উৎপাদনকারী বা সেবা প্রদানকারীর নিকট হতে মূসক পরিশোধপূর্বক গৃহীত হইয়াছে এবং যাহাদের নিজস্ব কোনো বিক্রয়কেন্দ্র নাই।’
এই সংজ্ঞা ঘোষণার পর মার্কেটপ্লেস ও অনলাইন শপ এর ক্ষেত্রে কিছু পদ্ধতিগত ভিন্নতা থাকার কারণে করনীতি তৈরিতে কিছুটা ঝামেলা হচ্ছে বটে। যদিও ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জুলাই প্রকাশিত ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় নির্দেশিকায় মার্কেট প্লেস এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, ‘‘মার্কেটপ্লেস অর্থ ইন্টারনেটে এক ধরনের ডিজিটাল কমার্স সাইট বা পোর্টাল যাতে এক বা একাধিক তৃতীয়পক্ষ কতৃক পণ্য সেবা সম্পর্কিত তথ্যাদি সন্নিবেশ করা থাকে এবং লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।’’
কিন্তু আইন বা রাজস্ব সংক্রান্ত নথি হওয়ার কারণে কর সম্পর্কিত কাজে এটা ব্যবহার করা যায়নি।
২০২৩-২৪ বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, অনলাইনে খুচরা বিক্রয় অর্থ- ইলেকট্রনিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারের মাধ্যমে সেইসব পণ্য সেবার ক্রয়-বিক্রয় যা ইতোপূর্বে কোনো উৎপাদনকারী বা পণ্য সরবরাহকারী বা ব্যবসায়ির নিকট হতে মূসক পরিশোধপূর্বক ক্রয় করা হয়েছে এবং অনলাইনে খুচরা বিক্রেতা কতৃক উক্ত ক্রয়কৃত পণ্য মূসক প্রদানপূর্বক সরবরাহ করা হবে। যেক্ষেত্রে উক্ত অনলাইন খুচরা বিক্রেতার নিজস্ব কোনো (ভৌত) বিক্রয়কেন্দ্র নেই।
এখানে সংজ্ঞাতে মূসক এর বিধান যুক্ত করা হয়েছে, ক্রয় করার পূর্বে একবার মূসক এর কথা বলা হয়েছে এবং বিক্রয় করার সময় আরেকবার মূসক এর কথা বলা হয়েছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মূসক আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো অনলাইন বিক্রেতাকে অনলাইনে পণ্যসেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে হয়তো তার সরবরাহকারী বা উৎপাদক বা আমদানিকারক মূসক প্রদান করেছেন এমন নথি প্রদান করবেন- এ নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যদি কোনো কারণে তা না করেন তাহলে তিনি সে মূসক প্রদান করবেন। এই নিয়মটি রহিত করতে কয়েক দফা চিঠি ও বৈঠক হয়েছে ই-কমার্স খাতের বাণিজ্য সংগঠন ই-ক্যাব ও রাজস্ব বোর্ড এর সাথে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক, যদি কোনো পণ্যের দাম হয় এক হাজার টাকা। এবং অনলাইন শপ থেকে এটা এক হাজার একশ টাকায় বিক্রি করা হয় এবং ৬০ টাকা ডেলিভারি চার্জ নিয়ে মোট এক হাজার একশ ৬০ টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া হয়, তাহলে তিনি শুধু বাড়তি (১০০+৬০=১৬০) টাকার উপর পাঁচ শতাংশ হারে মূসক দেবেন। মানে তার প্রদেয় মূসক হবে আট টাকা। কিন্তু কোনো কারণে তিনি যদি পূর্বের মূসক চালান দেখাতে না পারেন সেক্ষেত্রে তার উপর পুরো মূল্য, মানে এক হাজার একশ ৬০ টাকার পাঁচ শতাংশ হারে মূসক প্রযোজ্য হবে। যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৮ টাকা। ই-কমার্সে সবক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ লাভ করাও সম্ভব হয়না। তাছাড়া এক হাজার টাকার একটি পণ্যে বিভিন্ন রকম খরচ দিয়ে এই টাকা লাভ হয়না। এমনকি প্রকৃত প্রস্তাবে সব সময় ৬০ টাকা দামে পণ্য ডেলিভারিও সম্ভব হয়না।
এই সংজ্ঞা অনুসারে একটি অংশের উপর দুই বার মূসক ধরার আশংকা তৈরি হয়েছে। কর বাস্তবায়ন নীতি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। এছাড়া এই খাতের উদ্যোক্তাদের চাওয়া অনুযায়ী তারা বাড়তি মূল্য যোগের পাঁচ শতাংশ মূসক দিতে সম্মত আছেন। কিন্তু সরবরাহকারীর মূসক বিক্রেতার উপর নির্ধারণ করা সমীচিন নয়। সরকারের কর আদায়ের সুবিধার্থে সরবরাহকারীর অনলাইন শপ রাজস্ব বোর্ডকে সরবরাহ করতে পারে। এছাড়া আইটি ও আইটিইএস (আইটি এনাবল সার্ভিসেস) এর ক্ষেত্রে সরকার প্রদত্ত সুবিধাগুলো ই-কমার্স খাতেও দেয়া প্রয়োজন। সাথে সাথে প্রচলিত দোকান ও অনলাইন শপের সাথে যেসব বিষয়ে বৈষম্য রয়েছে সেগুলোও দূর করে একটি সম-প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি করা উচিৎ।
প্রসঙ্গত , বিগত ২০২৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রাজস্ব বোর্ড ই-কমার্স খাতে মূসক আদায়ের ক্ষেত্রে একটি নিয়ম প্রয়োগ করে আসছে। তাতে সবার ক্ষেত্রে একই মূসক প্রযোজ্য ছিলো। আর তা হলো, কোনো অনলাইন বিক্রেতাকে অনলাইনে পণ্যসেবা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে হয়তো তার সরবরাহকারী বা উৎপাদক বা আমদানিকারক মূসক প্রদান করেছেন এমন নথি প্রদান করবেন। তাহলে তিনি শুধু বাড়তি মূল্যের উপর মূসক পরিশোধ করবেন। মানে তার পণ্যের ক্রয়মূল্য যদি হয় একশ টাকা। এবং তিনি এটা ১২০ টাকায় বিক্রি করেন ও ৩০ টাকা ডেলিভারি চার্জ নিয়ে ১৫০ টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে নেন, তাহলে তিনি শুধু বাড়তি (২০+৩০=৫০) টাকার উপর পাঁচ শতাংশ হারে মূসক দেবেন। কিন্তু কোনো কারণে তিনি যদি পূর্বের মূসক চালান দেখাতে না পারেন সেক্ষেত্রে তার উপর পুরো মূল্য মানে একশ ৫০ টাকার পাঁচ শাতংশ হারে মূসক প্রযোজ্য হবে।
লেখক : জাহাঙ্গীর আলম শোভন, নির্বাহী পরিচালক, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)