বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভর্তি জালিয়াতির অধিকাংশ ঘটনাতেই উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইউসিসির নাম। বিভিন্ন সময়ে এই কোচিং এর শিক্ষকদের প্রক্সি দেওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতির ঘটনাও আছে ঢের। সম্প্রতি তারা প্রশ্নপত্রের প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউসিসির সাবেক এক কর্মকর্তার ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকায় জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইয়ে দিতো ইউসিসি। এখনও তারা এই প্রলোভনটা কাজে লাগিয়েই বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারছে।
প্রশ্নপত্রের আশায় ইউসিসিতে ভর্তি হওয়া ২০২১-২২ সেশনের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি আর আমার বন্ধু দুইজন একসাথেই ভর্তি হই। প্রশ্ন পাওয়ার লোভে পড়ে পড়াশোনা করিনি, ইউসিসিতে ভর্তির টাকাও নষ্ট। এখন সেকেন্ড টাইমের প্রস্তুতি নেবো।
অভিযোগ আছে, টানা কয়েক বছর ঢাবিতে ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিল ইউসিসি। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গেও তাদের নাম জড়িত বলে অভিযোগ ওঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে বিভিন্ন প্রমাণসহ জালিয়াত চক্রের সঙ্গে ইউসিসির সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনেন।
২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে চারটি ইউনিটে জালিয়াতির অভিযোগে আটক সাদনাম আহমেদ সৈকত, জায়েদ হাসান ও বদিউজ্জামান জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিজেদের ইউসিসির শিক্ষার্থী হিসেবে স্বীকার করেন। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আটক হাসিবুল হাসান সামু ইউসিসির কোচিং সেন্টারের শিক্ষকের সহায়তায় ৫ লাখ টাকার চুক্তির কথা স্বীকার করেন।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে তাদের দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদের মধ্যে পাঁচজনই ইউসিসির কয়েকজন শিক্ষকের সহযোগিতায় জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। এছাড়া একই শিক্ষাবর্ষে ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় আটকদের মধ্যেও তিনজন নিজেদের জালিয়াতির সঙ্গে ইউসিসির শিক্ষকের সম্পৃক্ততার কথা জানান। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে জালিয়াতির দায়ে আটকদের মধ্যে দুজন ছিলেন ইউসিসির ছাত্র। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হওয়া জাহিদ হাসান আকাশও জালিয়াতি করেছিলেন ইউসিসির মাধ্যমে।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে ইউসিসি কর্তৃপক্ষ সংবর্ধনার নাম করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ছবি, মোবাইল নম্বর, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও প্রাপ্ত জিপিএসহ ফরম পূরণ করিয়ে নেয়। এসব তথ্য ব্যবহার করে ইউসিসি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী শাখা থেকে প্রকাশিত প্রসপেক্টাসে সংবর্ধনার নামে তথ্য নেয়া রাবি শিক্ষার্থীদের ইউসিসি’র শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের কেউই ইউসিসিতে কোচিং করেননি।
এর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চারুকলায় প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন পাবনা গভর্নমেন্ট এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র রাকিন নাওয়ার। এরপরই রাকিনকে নিয়ে মিথ্যা বিজ্ঞাপনে মেতেছিল ইউসিসি। অথচ ইউসিসিতে "চ" ইউনিটের কোচিংই করানো হয় না।
ইউসিসিসহ অন্যান্য কোচিংগুলোর বিজ্ঞাপন চটকদার হলেও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে এসব কোচিং সেন্টারগুলো যথাযথ প্রস্তুতি নিতে বা পাঠদান দিতে পারছে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের এবং প্রশ্ন কমন আসার লোভ দেখিয়ে ইউসিসি ভর্তি কোচিংয়ে না পড়েও ‘মডেল টেস্ট’ প্রোগ্রামে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোরও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ইউসিসির বিজ্ঞাপন শুরু হলেও মূলত ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে চমকপ্রদ সব বিজ্ঞাপন সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুনে ছেয়ে ফেলে রাস্তা ঘাট। এর আগে অবৈধভাবে পোস্টার লাগানোর দায়ে ইউসিসিসহ ছয় কোচিং সেন্টারের লাইসেন্স বাতিল করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এরপরও রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যানার পোস্টার টানিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে কোচিং সেন্টারটি।
ইউসিসিতে কোর্স ফি ক ইউনিট+জিকে-১৭০০০ টাকা, খ/ঘ ইউনিট-১৬০০০ টাকা, গ ইউনিট + জিকে-২০০০০ টাকা, গ ইউনিট ১৮০০০ টাকা, ক+খ ইউনিট ২৮০০০ টাকা, গ+খ -২৮০০০ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ইউসিসির গ্রুপের পরিচালক এম এ হালিম পাটোয়ারীরকে একাধিকবার ফোনকল করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠানো হলেও সাড়া দেননি পাটোয়ারী।