ইসলামে শিক্ষকের মযার্দা - দৈনিকশিক্ষা

ইসলামে শিক্ষকের মযার্দা

মুহাঃ নূর বখ্ত, দৈনিক শিক্ষাডটকম |
ইসলামের প্রথম নির্দেশনা হলো ইকরা‘, যার অর্থ পড়। এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করেই শিক্ষা শব্দটির উৎপত্তি। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ ও জাতিসত্তাকে বিকশিত করার জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এটি জাতির মেরুদণ্ড। পৃথিবীতে প্রায় সকল জাতি বা গোষ্ঠি শিক্ষা শব্দটিকে প্রাধান্য দিয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের রূপরেখা অংকনে সক্ষম হন। একটি জাতি যত শিক্ষিত তার সমাজ ব্যবস্থা তত উন্নত ও সমৃদ্ধ। শিক্ষিত ও মূর্খ ব্যক্তির অবস্থা কখনও সমান হতে পারে না। এ কারণে যে একজন শিক্ষিত মানুষ অনায়াসে আলোর পথের সন্ধান পান। অন্যদিকে একজন মূর্খ মানুষ ক্রমশঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের দিকে অগ্রসর হন। মহান আল্লাহ বলেন, “যারা জানে আর যারা জানেনা, তারা কখনও সমান নয়”। তিনি অন্যত্র বলেন, “একমাত্র আলিম বা জ্ঞানীরাই আল্লাহ তা‘আলাকে সর্বাধিক ভয় করেন”। জ্ঞান অর্জনের পথ অবলম্বন করা মূলতঃ সহজভাবে জান্নাতের পথে ধাবিত হওয়ার নামান্তর। মহানবী (স.) বলেন, “যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন”। অন্য এক হাদীছে এসেছে, “আল্লাহ যাকে প্রভূত কল্যাণ দিতে চান, তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন”। অন্যত্র তিনি বলেন, “একজন আলিম বা শিক্ষকের মর্যাদা একজন জাহিল বা মূর্খের চেয়ে সেরকম, যেরকম সমগ্র তারকারাজীর উপর পূর্ণিমার চন্দ্রের অবস্থান”। তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আলিম তথা শিক্ষকের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়”। 

 

 
যুগ পরিক্রমায় আগত ও অনাগত সকল প্রজন্মকে দেশ ও জাতির নিকট সুপ্রিয় করে তোলার বীজ বপন করেন শিক্ষক সমাজ। তাদের বপিত বীজ চারা ও চারা থেকে গাছে পরিণত হয়। যার সুশীতল ছায়ায় সকল আশ্রিত ব্যক্তি উপকৃত হয় ও স্বস্তিবোধ করে। আদর্শ শিক্ষকের সুপরিকল্পিত পাঠদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাদান ছাত্র সমাজকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে তোলে। ফলে তারা অন্যায়, অবিচার, অপসংস্কৃতি প্রভৃতি অসৎ ও অসহনীয় কর্মকাণ্ডকে মোটেও সমর্থন করে না। সদা সর্বদা সেগুলোর অপনোদন করে শান্তি, শুঙ্খলা ও সুসংহতি রক্ষায় প্রাণপন চেষ্ঠা করে। যা সকলের নিকট সত্যিই প্রশংসনীয়।
 
শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। মহান আল্লাহ একজন স্বয়ংসম্পন্ন শিক্ষক। মহনবী (স.) একজন শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি বলেন, “আমি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি”। প্রাচীন যুগ হতে বর্তমান পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ শিক্ষকতার পেশাকে কর্মজীবনের সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এতে পার্থিব স্বার্থ শতভাগ নিশ্চিত না হলেও তারা অল্পে তুষ্ট হয়ে ছাত্র সামাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। মহানবী (স.) শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে বলেন,  ‘আল্লাহ ও রাসূলের পরে ঐ ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে, জ্ঞানার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে’। তিনি আরও বলেন, দু’ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো পদ গৌরব ও লোভনীয় নয়। প্রথমত ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ প্রাচুর্যতা দান করেন ও তা থেকে সৎ পথে ব্যয় করার সক্ষমতা দেন। দ্বিতীয়ত মহান আল্লাহ যাকে জ্ঞান দান করেন এবং তদনুযায়ী সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (স.) জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে সাহাবাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা যারা উপস্থিত তারা অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট এসব জ্ঞানের আলো পৌঁছে দিও”। মহনবী (স.) এর এ আদেশ পালনার্থে মক্কা ও মদীনার পবিত্র জমিন থেকে হাজার হাজার সাহাবী শিক্ষকতার মহান পেশাকে ব্রত করে দেশ ও দেশান্তরে বেড়িয়ে পড়েন। যারা আর মক্কা-মদীনায় ফিরে আসেন নি। 
 
একজন শিক্ষকের জন্য অবশ্য কর্তব্য শিক্ষার্থীকে সন্তানতূল্য মনে করে তাকে স্নেহের পাত্রে আসীন করা। এ মর্মে ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রা.) বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের চেহারায় একটি মাছি বসলেও কষ্ট পাই। শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখা একজন শিক্ষকের সহমর্মিতার পরিচায়ক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইমাম শাফি‘ই (রহ.) দরিদ্র অবস্থায় জ্ঞানার্জনের জন্য মদিনায় ইমাম মালিক (রহ.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় ইমাম মালিক (রহ.) তাকে নিজের মেহমান বানিয়ে নেন এবং তার সকল প্রকার প্রয়োজন মেটাতে তৎপর হন। শিক্ষার্থীর যৌক্তিক সকল প্রকার ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া শিক্ষকের মহৎ গুণাবলীর অন্যতম। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণে সকল প্রতিবন্ধকতা বিদূরিত হয়। উজ্জল ভবিষ্যত গঠনে আগ্রহবোধের সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। এই শ্রদ্ধাবোধের কারণেই যুগে যুগে ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকগণ সম্মানিত হয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস বলেন, আমি ছাত্র অবস্থায় নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ ও ফকির মনে করতাম। এ কারণেই আমি শিক্ষক হওয়ার পরে অধিক সম্মানিত হয়েছি। রাসূলের প্রখ্যাত সাহাবী ও অন্যতম ওহী লেখক হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা.) একদা এক জানাজা নামাজে গমন করে নামাজঅন্তে প্রস্থানকালে উঠের পিঠে চড়ে বসার সময় রেকাবের (উঠের পিঠে উঠার বাহন) উপর পা দিয়ে উঠতে ছিলেন। এমন সময় আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) এসে তার পায়ের নিচে দু’হাতের তালু বিছিয়ে দেন। যায়েদ বিন সাবিত (রা.) বলেন, এটা কিভাবে সম্ভব? অথচ আপনি নবী (সা.) এর চাচাতো ভাই ও আহলে বাইতের লোক। প্রতিত্তরে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বললেন, শিক্ষকদের এভাবে সম্মান করার জন্য আমাদের আদেশ করা হয়েছে। বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবূ হানীফাহ (রহ.) তার জীবদ্দশায় শিক্ষকের বাড়ীর দিকে পা বাড়িয়ে দেননি, যদিও শিক্ষকের বাড়ি তার বাড়ি থেকে অনেক দূরত্বের ব্যবধান ছিলো। 
 
৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সাল থেকে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিবসটি উদ্যাপিত হয়। শিক্ষকদের জন্য দিবসটি নিঃসন্দেহে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষত দেশীয় প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সাম্প্রতিককালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের আপামর জনতা এক স্বৈরাচার শাসক ও শোষকচক্রের হাত থেকে মুক্তি পায়। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। কিন্তু তৎপরবর্তী কতিপয় শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক হেনস্তা ও শিক্ষক অপমানের ন্যাক্কারজনক ঘটনা হিসেবে জাতিকে স্তম্ভিত করে তোলে। এহেন পরিস্থিতি হতে শিক্ষকদের সম্মানের আসনে আসীন করতে হলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা কারিকুলামে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ভাব ও মর্যাদা কেন্দ্রিক বিষয়সমূহ সন্নিবেশ করা অতীব প্রয়োজন।
 
ইতিহাসে দেখা যায়, আব্বাসীয়দের উল্লেখ্যযোগ্য খলিফা হারুন-অর-রশিদের দুই ছেলে আল-আমিন ও আল-মামুন তাদের শিক্ষকের পায়ে জুতা পড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েন। পরে দুই ভাই সমোঝতা করে দু’পায়ে দু’জন জুতা পড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ অবস্থা দেখে তাদের পিতা শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ব্যক্তির মর্যাদা বেশি? শিক্ষক ভীতস্বরে বললেন, এ যুগের খলিফা হারুন-অর-রশিদের মর্যাদা বেশি। এতদশ্রবণে খলিফা বললেন, আপনার জবাব সঠিক নয়। যার পায়ে জুতা পড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে খলিফার সন্তানেরা প্রতিযোগিতা করে, নিশ্চয়ই তার মর্যাদা বেশি।
মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উদ্দেশ্য করে কবি কাজী নেওয়াজের বিখ্যাত কবিতার ছন্দ কে না জানে! সম্রাটের পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিয়েছিলো, সম্রাট তা স্বচোখে দেখে শিক্ষককে ডেকে বললেন, শিষ্যকে কি শিখালেন? তার তো শুধু পায়ে পানি ঢেলে দেয়ার কথা নয়, স্বহস্তে পা ধুয়ে দেয়ার কথা। একথা শুনে শিক্ষক উৎফুল্লচিত্তে বলে উঠলেন, “আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান, উদার বাদশা আলমগীর”। এভাবে কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার “আমার পণ” নামক বিখ্যাত কবিতা “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি” আদেশ করেন যাহা মোড় গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে”।
বর্তমান কারিকুলামে এ জাতীয় শতশত জীবন গঠনমূলক কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করা অতীব প্রয়োজন। শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে; শিক্ষা বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এ নীতিকথার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষকের ন্যায্য অধিকারগুলো সুরক্ষা করা ও জীবন যাত্রার মান উন্নত করণে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা সময়ের অপরিহার্য দাবী। সরকারি ও বেসরকারিভাবে গৃহীত সক্রিয় উদ্যোগ জাতির এ প্রত্যাশা পূরণে কাজ করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। মহান আল্লাহ সহায় হোন। আমীন।
 
লেখক : অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম আলিয়া কামিল মাদ্রাসা,কুড়িগ্রাম

 

 

 

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বিপিসি ও বাকশিস‘র - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বিপিসি ও বাকশিস‘র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি আসছে! - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি আসছে! ‘আমরা রক্ত দিচ্ছি আর ওরা সচিবালয়ে বসে টাকা ভাগ করছে’ - dainik shiksha ‘আমরা রক্ত দিচ্ছি আর ওরা সচিবালয়ে বসে টাকা ভাগ করছে’ ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত ভর্তি কাল, ক্লাস শুরু ২০ অক্টোবর - dainik shiksha ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত ভর্তি কাল, ক্লাস শুরু ২০ অক্টোবর অবশেষে ইএফটিতে এমপিও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া শুরু - dainik shiksha অবশেষে ইএফটিতে এমপিও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া শুরু দুই শতাধিক জাল শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ - dainik shiksha দুই শতাধিক জাল শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042719841003418