উন্মাদনারও সীমা থাকা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাহফুজা খানম। সম্প্রতি দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপে পাঠ্যবই ছিড়ে ফেলার ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় নতুন শিক্ষাক্রমের পক্ষে-বিপক্ষের প্রতিক্রিয়া ও সাংবাদিকতার ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
সবার আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনারা সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করলেন। মৌলবাদিদের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন না আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানালেন। আমরা দেখলাম, আপনারাই প্রথম প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ফেরাম, যারা বিষয়টি নিয়ে ফরমালি বক্তব্য দিয়েছে। আপনাদের এই উদ্যোগের খবর প্রকাশে অধিকাংশ সংবাদপত্র যে নিজেদের গুটিয়ে রাখলো, সে বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? আমরা তো ইদানিং দেখছি, কারো কারো ফেসবুকের লেখাও মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করছে!
মাহফুজা খানম বলেন, সংবাদপত্রের একটি বড় ভূমিকা থাকার কথা ছিলো। কিন্তু সেটা আমরা দেখিনি। বিষয়টা অত্যন্ত দুঃখের ও লজ্জার। আমরা একটা মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ লাভ করেছি। ৩০ লাখ বাঙালির আত্মদানের ফলে যে বাংলাদেশ হলো, সেখানে বঙ্গবন্ধু আমাদের কুদরত ই খোদা শিক্ষা কমিশন আমাদের দিলেন। সেই শিক্ষা কমিশন বাস্তবায়নের সময়ে আমি বলব- এটা আরম্ভ করা মাত্রই আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারালাম, কেন হারালাম এটা একটু চিন্তা করার বিষয়। এই যে মহান মুক্তিযুদ্ধ, এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বিপক্ষে ছিলেন কারা, সেই আমেরিকা, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য এবং তারা চেয়েছিল এটা পাকিস্তান থাক…. যদি আমি নাম উল্লেখ করতে চাই, জিয়াউর রহমান এলেন, পরবর্তীতে এলেন এরশাদ সাহেব, এরা কিন্তু শিক্ষা নীতি থেকে ভিন্ন, একেবারে ভিন্নতর শিক্ষানীতি দিলেন। শিক্ষানীতিটা হচ্ছে- আমাদের সংবিধানের যে প্রধান স্তম্ভ, যাকে আমরা বলি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা, বাংলাদেশ গড়ার জন্য অবশ্যই বলবো যে, আমার আগামী দিনের চিন্তা-চেতনা ধারণ করবে আগামী প্রজন্ম।
তারা বড় হবে লেখাপড়ার ভেতর দিয়ে। আর তাদের লেখাপড়াটা কি হবে? শিক্ষাক্রমটাকে বদলে ফেলে, ধর্মভিত্তিক বিষয়ে নির্ভরতা বাড়িয়ে একটা শিশু যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বড় হয়ে উঠবে, সেই চেতনা থেকে অনেক দূরে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এর ফলে যেটা হলো, উনিশ বছর তারা, যারা বাংলাদেশের চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন না, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে শিক্ষানীতিকে নষ্ট করে ফেললেন। জিয়াউর রহমান আমাদের শিক্ষানীতিকে অসাম্প্রদায়িক থেকে সাম্প্রদায়িক করলেন। পরবর্তীতে এরশাদ সাহেব এসে রাষ্ট্র ধর্মই করে ফেললেন। কিন্তু, রাষ্ট্রের তো কোনো ধর্ম হতে পারে না। রাষ্ট্রের সকল হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আরো যত ধর্মের আছে সবাই বসবাস করবে এবং প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার হচ্ছে সমান। যেটা আমাদের সংবিধান বলা হয়েছে- নারী পুরুষ প্রত্যেকের, এমনকি এখন আমি বলব, আমাদের থার্ড জেন্ডার যেটা আমরা বলি তাকেও কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গা থেকে ৭৫ এর পরবর্তীতে দেশকে, জাতিকে, মনোজগতকে তারা একটা সাম্প্রদায়িক জায়গায় নিয়ে গেলো।
একুশে পদক পাওয়া এই শিক্ষাবিদ বলেন, গতবছর আমরা দেখলাম, ২৭ জন হিন্দু লেখককে পাঠ্য বই থেকে বাদ দেওয়া হলো। এর চেয়ে দুঃখের কিছু আছে কি? যে লেখককে তার ধর্মপরিচয় পরিচয় দিতে হয়, সে তো ধর্মের পরিচয়ে পরিচিত নয়। তার লেখাটা আমার সমাজের জন্য, আমাদের তরুণদের জন্য কতোটা প্রয়োজন সেটার আলোকে সেই লেখাগুলো আমাদের পাঠ্যক্রমে, পাঠ্যপুস্তকে আসার কথা। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলবো, এই জায়গায় থেকে আমাদের জাতির মনোজগত পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই যে নারীদের হিজাব যেভাবে বেড়েছে, এটা কি আমাদের বাঙালির সংস্কৃতি? এটা প্রমাণ করে যে, এরা বসে নেই, সেই ৭৫ এর পর থেকে তারা তাদের নীল নকশা অনুযায়ী কাজগুলো করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষাক্রমকে আসলে আধুনিক করতে হবে। সেই আধুনিকতার প্রধান কথাটা হবে- মানুষের প্রতি মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আমাকে তৈরি হতে হবে। আমাকে শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, প্র্যাকটিক্যাল প্র্যাকটিসের ভেতর দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রোম নিয়ে পানি ঘোলা করার কারণ তো আমি দেখি না। কিন্তু, ঠিকই ঘোলা করা হচ্ছে। একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করার কথা হচ্ছে। এই যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির যে শিক্ষক বই ছিড়ে ফেললেন, টাকা দিয়ে বই কেনার কথা বললেন…. কিন্তু, পাঠ্যবই বই তো এভাবে বিক্রি হয় না, এটাও কি উনি জানেন না? পাঠ্য বই তো দেয় সরকার। অথচ তিনি প্রত্যেকের প্রতি আহ্বান জনালেন, আপনারা বইটা কিনবেন এবং এক টান দিয়ে পাতাগুলো ছিড়ে আবার অর্ধেক দাম দিয়ে ফেরত দেবেন। এটা কি ধরনের কথা? একজন শিক্ষক কি এমন কথা বলতে পারেন? এখানে একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করার ব্যাপার আমরা লক্ষ্য করছি। কিন্তু, উন্মাদনারও তো একটা সীমা আছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজা খানম বলেন, আর একটা বিষয় হলো, মাত্র আমাদের নির্বাচন হয়ে গেলো। এই নির্বাচন নিয়ে আমরা দেখেছি- কতো রকমের অপপ্রচার চলেছে। এখনো চলছে। সেই নির্বাচন কে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নানা সমস্যা তৈরি করেছে। নবনির্বাচিত সরকারের বিরদ্ধে তারা এখনো বক্তব্য দিয়েই বলেছে। তাদের এই নীল নকশার একটি অংশ হলো নতুন পাঠক্রম নিয়ে অপপ্রচারণা। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের জনমত গঠন করতে হবে। আধুনিক শিক্ষাক্রমের ভেতরে যেতে হবে। হ্যাঁ, সেখানে ভুল ত্রুটি থাকতে পারে, সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেখানে আমাদের বর্তমানের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাহেব বলেছেন, প্রয়োজনে আলোচনার ভেতরে আমরা যোগ বিয়োগ করব। তার মানে ফেলে দেওয়া এক কথা, এটাকে নিয়ে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমাজে ছড়াচ্ছে, যেভাবে এটাকে একটা উন্মাদনা তৈরি করে পলিটিক্যাল ইস্যুকে তারা এগিয়ে নিয়ে আসছে। এসব থেকে তাদের বিরত হওয়া উচিত। দৈনিক আমাদের বার্তা পত্রিকায় যেভাবে আপনারা আপনাদের খবরটি প্রচার করেছেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত। মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবি মেনে পরিবর্তন নয়, এই কথাটা প্রথম হেডলাইন করেছেন, এজন্য আপনাদের আমি বলব, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির পক্ষ থেকে এবং বিশ্ব টিচার্স ফেডারেশন সভাপতি হিসেবে, এদেশের সকল শিক্ষকের পক্ষ থেকে এবং বিশ্বের সকল শিক্ষকের পক্ষ থেকেই আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র নারী ভিপি মাহফুজা খানম আরো বলেন, আমরা ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির পক্ষ থেকে যে কথাটা বলেছি, আমরা কোনোভাবেই এ শিক্ষাক্রম থেকে পিছিয়ে আসবো না, যোগ বিয়োগ হতে পারে, সমস্যা হতে পারে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা ট্রল এন্ড এরর মেথড এর ভেতর দিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছাবো। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম দেখেছি, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়- এটাই নিয়ম। আমাদের শিশুরা যেনো সাম্প্রদায়িক নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠে। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য লড়ে যাব। আমি মনে করি, এখানে সাংবাদিকদের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা ছয় দফা কে আমরা ধারণ করে সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী, সংবাদের যিনি সম্পাদক ছিলেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যিনি ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলেন, তারা যেভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছেন তাদের পত্রিকার মাধ্যমে, তাদের মতো এখনকার পত্রিকার ও সাংবাদিকের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
বিশ্ব শিক্ষক পরিষদের বর্তমান সভাপতি মাহফুজা খানম বলেন, আমরাও সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে রয়েছি, আপনারা এ দেশের মানুষের মনোজগতকে পরিবর্তন করবেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আলোকে আলোকিত করবেন।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।