কারিগরি শিক্ষায় প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। এই শিক্ষায় উপবৃত্তিও বাড়ছে। এরপরও পূরণ হচ্ছে না এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা। ‘এনরোলমেন্ট’ বা শিক্ষার্থীর তালিকাভুক্তির ধীরগতিতে বাড়ায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা প্রত্যাশিত গতিতে এগুচ্ছে না বলে কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাদের অভিমত, শিক্ষার্থীদের ‘স্বার্থ’ যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিয়ে ‘ব্যক্তিস্বার্থে’ একের পর এক নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় ও বিদেশি ঋণ বাড়ছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত শিক্ষানীতি অনুযায়ী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা অগ্রসর হচ্ছে না। এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বাড়াতে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে না। এ শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নিজেদের ‘স্বার্থে’ নতুন নতুন প্রকল্প নিচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষাবিদদের পরামর্শ বা মতামতের তোয়াক্কা করছেন না।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কারিগরি শিক্ষায়-২০২২ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৮১ হাজার ৪৮৫ জন। কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং নারী শিক্ষার্থীর হার ২৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও গত বছর সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল।
অথচ এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ শতাংশে (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর) উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার্থী ৪১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এছাড়া কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভর্তির ক্ষেত্রে মহিলা কোটা ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে নারীবান্ধব ট্রেড/টেকনোলজি চালু করা হয়েছে।
‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেছেন, ‘শিক্ষানীতিতে আমরা বলেছিলাম, প্রতি উপজেলায় একটি করে নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করতে। যেখানে শুধু কারিগরি শিক্ষা দেয়া হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান চালু হলো না। শুনছি- হবে, হচ্ছে। এর মধ্যে কর্মকর্তারা প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ হাই স্কুলে কারিগরি শিক্ষা ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেখানে ঠিকমত শিক্ষক দেওয়া হয়নি, যন্ত্রপাতি যা দেওয়া হয়েছে সেগুলিও ঠিকমত কাজ করছে না, কোথাও কোথাও তা দেয়াই হয়নি।’
কারিগরি শিক্ষার বিকাশে শিক্ষানীতির আলোকে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের নামে কেনাকাটা (শিক্ষা উপকরণ) করে টাকা-পয়সা ভাগভাটোয়ারা হচ্ছে। এভাবে কী কারিগরির বিকাশ ঘটবে?’
জানতে চাইলে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘বিশ^বাস্তবতায় কারিগরি শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে এই শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রথাগত ও সাধারণ শিক্ষায় শুধু বেকার তৈরি না করে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে।’
কারিগরি শিক্ষায় নানা রকম সমস্যা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রশাসনেও স্মার্ট লোকজনকে বসাতে হবে।’
উপবৃত্তি বাড়ছে দ্রুতগতিতে
কারিগরি শিক্ষায় অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আগ্রহী করতে এবং দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান ও বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। ‘জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পেমেন্ট সিস্টেমে’র মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি সকল কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে তিন হাজার ৭৫৫টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট ছয় লাখ ৪১ হাজার ৩০০ জন কারিগরি শিক্ষার্থীকে ১৬৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।
পরবর্তীতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৯ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৭ জন শিক্ষার্থীকে ২৮২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ১২ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮২ জন শিক্ষার্থীকে ৪২৫ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপবৃত্তির মধ্যে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা ও শিক্ষা উপকরণ বাবদ প্রতি সেমিস্টারে এক হাজার টাকা; এইচএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি ৫০০ টাকা ও শিক্ষা উপকরণ বাবদ প্রতি বছর এক হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া এসএসসি/দাখিল (ভোকেশনাল) শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি ৩০০ টাকা; অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি ২৮৫ কোটি টাকা এবং ৬ষ্ঠ-৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক উপবৃত্তি ২৩৫ টাকা দেয়া হয়।
বাড়ছে প্রতিষ্ঠানও
কারিগরিতে বিভিন্ন ‘ট্রেড’ ভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়। ২০১৯ সালে দেশে সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল মোট আট হাজার ৬৭৫টি। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এই সংখ্যা ১১ হাজার ১১৮টি।
এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন ২১১টি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। বর্তমানে এই অধিদপ্তরের আওতায় এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুই হাজার ৩১০টি। এসব প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী আছেন ২০ হাজার ৭৮৭ জন। এ হিসেবে প্রতিটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নূন্যতম ৯ জন শিক্ষক এমপিও সুবিধা পাচ্ছেন।
আর সরকারি ও বেসরকারি মোট ১১ হাজার ১১৮টি প্রতিষ্ঠানে মোট ১৬ লাখ শিক্ষার্থী ধরা হলেও একেকটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৩ জন। দেশের যেকোনো এমপিওভুক্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘দেড়শ’ শিক্ষার্থী ‘খুব একটা’ বেশি নয়।
প্রকল্পে আগ্রহ বেশি নীতিনির্ধারকদের
কারিগরিতে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সংখ্যা সেভাবে না বাড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যস্ত নতুন প্রকল্প গ্রহণে। কারণ প্রকল্পে নানা ধরণের ‘আর্থিক’ ও ‘ভ্রমণ’ সুবিধা থাকে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, যে কোনো সরকারি প্রকল্পেই কম-বেশি কর্মশালা, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, নানা রকম কেনাকাটা, পরামর্শক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতনে চাকরির সুবিধা, নামি-দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে চড়ার সুযোগসহ অনেক ধরনের ব্যক্তিস্বার্থের সুবিধা থাকে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ইকরামুল কবির বলেন, ‘প্রকল্পে আয়-রোজগার বেশি, কেনাকাটা আছে, ভ্রমণ আছে, গাড়ি আছে। কিন্তু শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণী পাস করে শিক্ষার্থীরা ভোকেশনালে যাবে। তারা কেন সাধারণ স্কুল ছেড়ে সেখানে যাবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী, সুবিধা কী, চাকরির বাজার কী-এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার দায়িত্ব শিক্ষা প্রশাসনের। বাস্তবে এগুলো হচ্ছে না। কর্মকর্তারা ছুটছেন প্রকল্পের পেছনে।’
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে বর্তমানে অন্তত ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকারের নিজস্ব অর্থানে নতুন আরো চারটি প্রকল্প গ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলি হলোÑ ‘৮টি বিভাগীয় সদরে ৮টি মহিলা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন’, ‘কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন ৮টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একাডেমিক ভবন নির্মাণ’ এবং ‘১২টি সরকারি পলিটেকনিক ও ৩টি মনোটেকনিক ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি’।
এছাড়া ‘এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক’ (এডিবি) এর অর্থায়নে ‘টিভিইটি টিচার্স ফর ফিউচার’ (টিটিএফ) শীর্ষক প্রকল্প প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন, চলমান কারিগরি প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের উপর ‘বিশেষ গুরুত্বারোপ’ করার কথা বলা হয়েছে।