ধর্মীয় মৌলবাদী ও পুঁজিবাদীদের ভেতর বিস্তর ব্যবধান। একদল প্রাচীনপন্থি, অন্যদল আধুনিক; কিন্তু তাদের মধ্যে চমৎকার মিল রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে আস্থার ব্যাপারে। এই আস্থা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে প্রকাশিত হয়, প্রকাশ দেখা যায় মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও; উভয় দলই মেয়েদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলেই ধরে নেয়। তাই দেখা যায় মৌলবাদীদের শাসনে নারীর অধিকার সীমিত করে ফেলা হয়, পারলে তাদের অস্তিত্বকেই ঢেকে রাখার চেষ্টা চলে আবরণ দিয়ে; অন্যদিকে পুঁজিবাদী আধুনিকেরা মেয়েদের পোশাক দেয় ছোটখাটো করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না নারী-ধর্ষণ। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
বাংলাদেশের সমাজে অধিকাংশ নারীই মৌলবাদী শাসনের অধীনে বসবাস করে। তবে তারা ওই বন্ধন ছিন্ন করতে যে চেষ্টা করে না, এমনও নয়। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। তারা মৌলবাদী পিতৃতান্ত্রিক অবরোধের তোয়াক্কা করে না। সাম্প্রতিক কালে যেটা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে, সেটা হলো কিছুসংখ্যক মেয়ে বিদেশেও যাচ্ছে, কাজের খোঁজে। দুঃসাহসিক পদক্ষেপ বৈকি; কিন্তু তবু সেটা তারা নিচ্ছে। বিদেশে গিয়ে তারা বিপদে পড়ে, সেসব বিপদের মধ্যে যৌন হয়রানিই প্রধানতম। তবু তারা যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা ভাঙতে চাইছে, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। জরিপ বলছে এক বছরে ১০৯ জন নারী কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে বিদেশে; আত্মহত্যা করেছে ২২ জন, খুন হয়েছে ২২ জন, অপমৃত্যু ঘটেছে ১১ জনের। এই মেয়েদের সন্তানরা দেশে কী অবস্থায় পড়েছে, সেটা কল্পনা করাটা সহজ নয়। পুরুষ-কর্মীরাও বিদেশে গিয়ে প্রাণ হারায়, তবে তাদের মৃত্যুতে সন্তানরা হয়তো অমন অতল পাথারে পড়ে না, বিদেশে গিয়ে প্রাণ হারানো নারীদের সন্তানরা যেভাবে বিপদে পড়ে। লাঞ্ছিত হয়ে বহু নারী দেশে ফেরে। তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক যন্ত্রণা মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে কম দুঃসহ হয় না। আমরা বলে থাকি; এবং কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সত্য বলে জেনে নিই যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, অর্জিত হলে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান না ঘটুক, অন্তত তার দাপটটা কমতো। ঘরে-বাইরে মেয়েদের লাঞ্ছনা হ্রাস পেতো। মেয়েদের চরমতম লাঞ্ছনা ঘটেছে একাত্তরে, হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে, কিন্তু বিরাজমান যে শেষ হয়নি, সেটা একটা কারণ যে জন্য দেশজুড়ে এখন এমন সর্বগ্রাসী হতাশা ও বিষণ্নতা।
মেয়েরা ঋণ করে এবং ঋণগ্রস্ত হলে তাদের কারো কারো অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়, তার দৃষ্টান্ত অসংখ্য; দৃশ্যমান যতটা না অজানা সে তুলনায় বহু গুণ অধিক। আত্মহত্যা করেছেন অনেক নারী যাদের দুঃসহ যন্ত্রণাকে মোটেই ব্যতিক্রম বলা যাবে না। কোনো মতেই নয়।
মেয়েদের অনেক পেশায় যেতে হয়। যায় তারা চলচ্চিত্র অভিনয়েও। চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থানটা ইদানীং মোটেই ভালো যাচ্ছে না। চলচ্চিত্র সামাজিকভাবে দেখবার জিনিস। করোনার আক্রমণে মানুষের ভেতরকার সামাজিকতা কেবল যে কমে গেছে, তাই নয়, করোনা সংক্রমণের শঙ্কায় সামাজিকতা বিপজ্জনকই হয়ে উঠেছে। সামাজিকভাবে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা তাই নিরুৎসাহিত হচ্ছে। সিনেমার অনেক প্রেক্ষাগৃহ এরই মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চলচ্চিত্রের তাই চাহিদা কম, নায়ক নায়িকাদের পসার পড়ে গেছে। সিনেমা দর্শকের মধ্যে নায়িকাপ্রীতির যেহেতু আধিক্য, নায়িকাদের তাই ভালো সময় যাচ্ছে না। তারা পড়েছে মুশকিলে। ওদিকে সিনেমার জন্য উপযোগী ভালো গল্পও আজকাল তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ওই একই। চাহিদাতে ঘাটতি। নায়িকাদের তাই এখন সম্ভব অসম্ভব নানা ভূমিকায় নামতে হচ্ছে। কেউ যাচ্ছে সুন্দরবনে, দুর্ধর্ষ অভিযানে। কাউকে সাজতে হচ্ছে প্রাইভেট ডিটেকটিভ, একজন নায়িকা শুনলাম মাদকপাচারকারীর ভূমিকায় নেমেছেন, আরেকজনকে সাজতে হয়েছে রিকশাচালক। এসব তো তবু গেল, যা দেখে খুবই পীড়িত হতে হয়, তা হলো সংবাদপত্রের তথাকথিত বিনোদন পাতায় সংক্ষিপ্ত, বেশভূষায় নায়িকাদের সরব উপস্থিতি। যেন পতনের জন্য উন্মুখ শৈল্পিক চাহিদাকে কোনোমতে ধরে রাখা যায় কিনা, তার শেষ চেষ্টা। পত্রিকাওয়ালারাও নগ্নপ্রায় ছবিগুলো অনেকটা লুফে নেয়, পত্রিকার কাটতি ধরে রাখা যাবে এই আশায়। মুদ্রিত অনেক ছবিতে দেখা যায়, মেয়েটি নিজেকে যতটা সম্ভব উন্মোচিত করে দিয়েছে, বাকি যা আছে, তা সামান্যই। প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই মনে হয় না, এসব কসরতে মেয়েটি খুশি। কাজটা সে করছে নিতান্ত নিরূপায় হয়েই, কারখানার নারী শ্রমিকরা যেভাবে শ্রম বিক্রি করে, প্রাণের দায়ে, অনেকটা সেভাবেই। আনন্দের কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। মুখে, অবয়বে, ভঙ্গিতেÑসর্বত্র বিষণ্নতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাসিখুশি ভাব থাকে, যেটা শুধু কৃত্রিমই নয়, কান্না চেপে রাখার বুঝি-বা বেদনাদায়ক চেষ্টা মাত্র। যেন বাংলাদেশে বিদ্যমান বিষণ্নতারই প্রতিমূর্তি এরা একেক জন; এবং প্রত্যেকেই।
ঋণের প্রসঙ্গ আসে। মহাজনি ঋণের অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের বহুকালের। যতই যা বলি, ‘ঋণ করে ঘি খাও’ প্রবচনটিতে মনে হয় একটা সতর্কবাণী রয়েছে, যেন বলা হচ্ছেÑ ওই পথে যেয়ো না, বিপদে পড়বে। অতিরিক্ত ঘৃতভক্ষণ স্বাস্থ্যের জন্য এমনিতেই ক্ষতিকর, তদুপরি ঋণ করে যদি ওই কাজ করতে হয়, তাহলে তো বুঝতেই হবে যে গ্রহিতাকে নির্বুদ্ধিতায় পেয়েছে। তবে নির্বোধেরাই যে কেবল ঋণ করে তা তো নয়; অধিকাংশ মানুষই ঋণ করে বাধ্য হয়ে। আর কোনো রাষ্ট্র যখন ঋণের জন্য আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাছে ধর্ণা দেয়, তখন বুঝতে হবে কর্জ না করলে তার সংসার অচল। আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। তারা ঋণ দেয় মুনাফার জন্য, এবং চূড়ান্ত বিচারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাকে টিকিয়ে রাখবার মহৎ উদ্দেশ্যেই। সুদখোর সাধারণ মহাজনের চাইতে অনেক বড় দায়িত্ব তাদের কাঁধে, তবে আচরণটা সাধারণ মহাজনের তুলনায় অধিক দক্ষ, সুচতুর ও বলপ্রয়োগকারী। ঋণ দেওয়ার আগে শর্ত দেয়। আর সেই শর্তগুলো কখনোই মধুর মতো মিষ্টি হয় না, বিষের মতো মারাত্মক হয়, খাঁটি বিষ না হলেও বিষাক্ত বটে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করেছে, তাতে কোনো কোনো রাষ্ট্রের জন্য দেউলিয়া হওয়ার দশা দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার হাল তো সবাই জানে। বাংলাদেশ ঋণের জন্য কাতর হয়েছে, সরকারিভাবে এমনটা আগে কখনোই বলা হয়নি। কিন্তু এখন আমরা জানতে পারছি, ‘খুবই খুশির খবর’ যে আইএমএফ ঋণ দিতে রাজি হয়ে আমাদের মহা উপকার করতে যাচ্ছে। কী কী শর্তে ঋণ দিচ্ছে, তা অবশ্য জানা যায়নি, জানা গেলেও আমরা যে সেসবের মর্মার্থ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ পুরোপুরি বুঝতে পারব এমন আশা সঠিক নয়। অর্থনীতির ভাষা ও ভাষ্য এক সময়ে হয়ে দাঁড়িয়েছিল পুরোপুরি অংক ও পরিসংখ্যান নির্ভর। ওই সব আবরণে এখন আর কুলাচ্ছে না, এখন ভাষাকে অনেক মধুর (যদিও আগের মতোই দুর্বোধ্য) করে তোলা হয়েছে। তবে ভাষায় যতই মাধুর্য থাকুক না কেন, আরোপিত শর্তগুলোর তীব্র কষাঘাতের জ্বালা আমরা ইতিমধ্যেই টের পেতে শুরু করেছি। যেমন ভর্তুকি প্রত্যাহারের ঘটনা। ভর্তুকি প্রত্যাহারের কৃপায় এক মাসের মধ্যে বিদ্যুতের দাম দুই দুইবার লম্ফ দিয়েছিল, আগামীতে মনে হয় আরও দেবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোও শর্তের অন্তর্ভুক্ত, নইলে মধ্যবিত্তের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগের ওই ক্ষেত্রটি এমনভাবে সংকুচিত হতে যাবে কোন দুঃখে? রাজস্ব খাতে আয় বাড়াতে হবেÑ এটা যে শর্তের শীর্ষস্থানেই রয়েছে, সেই সত্যটাও চাপা থাকেনি, প্রকাশ্য হয়ে গেছে। রাজস্বের এই বৃদ্ধিটা কীভাবে ঘটানো হবে? বৃদ্ধি নিশ্চয়ই আকাশ থেকে নেমে আসবে না, মাটি ফুঁড়েও বেরিয়ে আসবে না, অন্যসব অর্থের মতোই রাজস্বের অর্থও উৎপাদিত হবে মানুষের শ্রমেই। মানুষের ‘মঙ্গলে’র জন্যই কর্জ করা হবে এবং তাতে জ্বালাযন্ত্রণা বাড়বে অন্য কারো নয়, মানুষেরই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা সাধারণ মানুষের কথাই ভাবছিÑযারা শ্রম বিক্রি করে খান, তাদের কথা। তাদের কথা অবশ্যই নয়, যারা ঘৃতাহারি। ভয় হচ্ছে মেহনতিদের নিত্যসঙ্গী, করের নতুন ভয়, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এটা কোনো সুখের খবর নয়। আইএমএফের অভ্যাস অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর শর্তদান। কোনটা অপ্রয়োজনীয় আর কোনটা অত্যাবশ্যকীয়, সেটি তারাই নির্ধারণ করে দেয় কি না জানি না, রাষ্ট্রের হয়তো সে ব্যাপারে কিছু ‘স্বাধীনতা’ থাকে। দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কা আইএমএফের শরণাপন্ন হয়েছিল। ঋণ পেয়েছে, এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাসের জরুরি পরামর্শটাও নিশ্চয়ই পেয়েছিল। একই সঙ্গে। কিছু পদক্ষেপ তারা নিয়েছেও বলে শোনা গিয়েছিল, যার মধ্যে একটি হলো সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলা। তবে এমন পরামর্শ আইএমএফ দিয়েছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, বিদেশি আক্রমণ প্রতিহতকরণ যেমন-তেমন, অভ্যন্তরীণ ‘বিশৃঙ্খলা’ দমানোর, অর্থাৎ পুঁজির যাতে বিপদ না ঘটে, সেটা দেখার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ওপর আইএমএফসহ বিশ্ব পুঁজিবাদী সকল প্রতিষ্ঠানই আস্থা রাখে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশাটা ছিল অপ্রত্যাশিত, সেনাবাহিনীর সাইজ খাটো করার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকেও অপ্রত্যাশিতই বলতে হয় বৈকি।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়