অবিভক্ত বাংলার জাতীয় নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার জন্য ছিলেন সুপরিচিতি। তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সর্বভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ফজলুল হক। তার আপোষহীন ন্যায়নীতি ও অসামান্য বাকপটুতার কারণে রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন শেরে বাংলা (বাংলার বাঘ) নামে। সর্বভারতীয় রাজনীতির পাশাপাশি গ্রাম বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য সর্বপ্রথম তিনি একটি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে বরিশাল জেলায় বাকেরগঞ্জের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাতুরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আইনজীবী কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ও সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র ছিলেন তিনি।
এ কে ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়ির পরিবেশে। বাড়িতেই তিনি আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষায় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পরে তিনি ভর্তি হন বরিশাল জেলা স্কুলে এবং সেখান থেকে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রাস পাস করার পর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রখর মেধাসম্পন্ন ছাত্র ছিলেন ফজলুল হক। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ফজলুল হকের মেধায় তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একই বছরে রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পরীক্ষা পাস করেন, যা ছিলো একটি বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি ইংরেজি ভাষায় এমএ পাঠ শুরু করলেও পরে১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে গণিতশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি নেন।
কথিত আছে তিনি ইংরেজি ভাষায় এমএ পড়তে গেলে তার এক সহপাঠী তাকে বলেছিলেন মুসলমান শিক্ষার্থীরা অঙ্ক পড়তে ভয় পায়। সে কারণেই তিনি ইংরেজিতে এমএ পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেনন। ওই সহপাঠীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাত্র ছয় মাসের প্রস্তুতি নিয়ে অঙ্কে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন ফজলুল হক।
তিনি আইনেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এবং কলকাতার খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখার্জির অধীনে আইনের শিক্ষানবীশ হয়েছিলেন। দুবছর শিক্ষানবিশীর পর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। যদিও এক বছরের মাথায় পিতার মৃত্যুর পর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন বরিশালে এবং সেখানে বরিশাল আদালতে যোগ দিয়েছিলেন।
আইন ব্যবসা ছেড়ে ফজলুল হক ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকরি নেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ থেকে ইস্তফা দেন । আবার তিনি ফিরে গেলেন কলকাতা হাইকোর্টে আইনের পেশায়।
সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা দেখেছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদের ওপর জমিদার ও মহাজনদের নির্মম অত্যাচার। তার সেই অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী জীবনে দরিদ্র নিপীড়িত কৃষক সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে তিনি প্রবর্তন করেছিলেন ঋণ সালিশী বোর্ড, প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের পর এনিয়ে বাংলার জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়লে, ঢাকার চতুর্থ নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন তৈরির কথা ভাবেন। তিনি ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহ্বান করেছিলেন। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ফজলুল হক।
সেই অর্থে মুসলিম লীগের পথচলার শুরু থেকেই দলটির সঙ্গে ছিলেন তিনি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি। ওই একই সময়ে পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
দিল্লিতে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফজলুল হকই ছিলেন একমাত্র বাঙালি যিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন।
লক্ষ্ণৌ শহরে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, তা ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে অভিহিত হয়। এই চুক্তির অন্যতম একজন প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ফজলুল হক। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রাদেশিক পর্যায়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। ওই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। তিনিই ছিলেন এ পদে অধিষ্ঠিত প্রথম বাঙালি মুসলমান।
ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৩০ এবং ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পরপর বেশ কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের সভাপতিত্বে। লন্ডনে অনুষ্ঠিত ১৯৩০-৩১ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম বৈঠকে কংগ্রেসের যোগদান প্রত্যাখান করেছিলেন গান্ধী। দ্বিতীয় বৈঠকে অবশ্য যোগ দিয়েছিলো কংগ্রেস। কিন্তু মুসলিম লীগ ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলো। ফজলুল হক ওই বৈঠকে বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলেন। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষেও বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবার পর ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ব্রিটিশ ভারতে প্রজা পার্টি নামে সামন্ততন্ত্র বিরোধী যে দল ছিলো ফজলুল হক সেটির রূপান্তর ঘটান কৃষক-প্রজা পার্টি নামে রাজনৈতিক দলে। ওই নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে তার দল তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং নির্দলীয় সদস্যদের সঙ্গে জোট গঠন করে এ কে ফজলুল হক হন অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশন। ২২ থেকে ২৪শে মার্চ তিনদিনের ওই অধিবেশনে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম ‘পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব’ পেশ করেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব এবং উত্তরপশ্চিমের মুসলমান প্রধান অংশে ‘স্বায়ত্তশাসিত পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার দাবি সম্বলিত সেই প্রস্তাব গৃহীত ও পাস হয় ওই অধিবেশনে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ ছিলো একটি ঐতিহাসিক দলিল, যা পরে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত হয়।
তার ওই বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসীরা তাকে উপাধি দিয়েছিল শের-ই-বঙ্গাল অর্থাৎ বাংলার বাঘ। তখন থেকে তিনি শেরে-বাংলা নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই মেয়াদের দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তিনি বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। এ সময়ে তিনি ‘ঋণ সালিশী বোর্ড’ গঠন করেন, যার ফলে দরিদ্র চাষীরা সুদখোর মহাজনের কবল থেকে রক্ষা পায়।
ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাবার পর ফজলুল হক ঢাকায় চলে যান এবং ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও কার্যকর হবার পর তিনি স্বারষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে করাচি থেকে ঢাকা চলে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পদে তিনি ছিলেন ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বছর পাকিস্তানের এক অভ্যূত্থানের পর তাকে গৃহবন্দী করা হয়।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ফজলুল হকের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে তার প্রচেষ্টায় মুন্সিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা হয় হরগঙ্গা কলেজ।
তার নিজের গ্রামেও তিনি একটি কলেজ এবং পাশাপাশি মাদরাসা ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফজলুল হকের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ইসলামিয়া কলেজ ও মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লেডি ব্র্যার্বোন কলেজ। এছাড়া তিনি মুসলমানদের শিক্ষিত করে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন। এ কে ফজলুল হক ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ এপ্রিল ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।