এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষায় জিপিএ ৫ এমনকি গোল্ডেন জিপিএ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ৯০ শতাংশই ফেল করছেন। অথচ তাদের এইচএসসি ও আলিমের সিলেবাসের ভেতর থেকেই অধিকাংশ প্রশ্ন এসেছে। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গতবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। তাদের বেশিরভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। তাদের সর্বোচ্চ পাসের হার ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ পাস করেছেন একটি ইউনিটে।
শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক ও শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলেছেন, বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় শিক্ষার মানের বিষয়টি বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীকেই যোগ্য মনে করা হয়, বেশি শিক্ষার্থীর পাসের সুযোগ থাকে না। আমাদের পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন আছে। শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পড়ালেখা করে জিপিএ-৫ পেয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় ধরা পড়ছে তাদের পড়াশোনার মান আশানুরূপ নয়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার চারটি ইউনিটের ফল প্রকাশিত হয়েছে। কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ-সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১ লাখ ১৫ হাজার ২২৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। উত্তীর্ণ হয়েছেন ১১ হাজার ১৬৯ জন; অর্থাৎ পাসের হার ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মোট আসনসংখ্যা ২ হাজার ৯৩৪টি।
বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। উত্তীর্ণ হয়েছেন ১১ হাজার ১০৯ জন। পাসের হার ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মোট আসনসংখ্যা ১ হাজার ৮৫১টি।
ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৩৮ হাজার ২৩৫ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। উত্তীর্ণ হয়েছেন ৪ হাজার ৫২৬ জন; অর্থাৎ পাসের হার ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। মোট আসনসংখ্যা ১ হাজার ৫০টি।
চারুকলা ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় ৪ হাজার ৭২৬ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। উত্তীর্ণ হয়েছেন ২১২ জন। পাসের হার ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মোট আসনসংখ্যা ১৩০টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটউটের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, ‘আমাদের আসন সীমিত। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় প্রতিযোগিতা হয়। প্রশ্নের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাসের ক্ষেত্রেও অনেক শর্ত থাকে। পরীক্ষার খাতা দেখেন আমাদের শিক্ষকরা। সেখানেও পৃথক মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যারা খুব ভালো তারাই সুযোগ পান। শিক্ষার্থীরা বইমুখী হয় না, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫টি ইউনিটে অংশগ্রহণ করেছিলেন ২ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৫ জন শিক্ষার্থী। পাস করেছিলেন ২৭ হাজার ৪৮৮ জন। ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অথচ ওই বছর এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন। পাঁচ-ছয় বছরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার চিত্র প্রায় একই।
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছভুক্ত (জেনারেল, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় মোট আবেদনকারী ছিলেন ৩ লাখ ৩ হাজার ২৩১ জন। এ ইউনিটে (বিজ্ঞান) আবেদন করেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯২৩ জন; পাসের হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বি ইউনিটে (মানবিক) আবেদন করেন ৯৬ হাজার ৪৩৫ জন; পাসের হার ছিল ৫৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর সি ইউনিটে (বাণিজ্য) আবেদন করেন ৩৯ হাজার ৮৬৫ জন; পাসের হার ৬৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
জানা যায়, গুচ্ছ ভর্তিতেও বেশিরভাগ জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা আবেদন করেন। জিপিএ-৪ থেকে ৫-এর নিচের শিক্ষার্থীদেরও অনেকে আবেদন করেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় গুচ্ছে প্রশ্ন গতানুগতিক ও তুলনামূলক সহজ। অথচ এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল করেও অনেক শিক্ষার্থী গুচ্ছ ভর্তিতে ফেল করেছেন।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশ্লেষক মাছুম বিল্লাহ বলেন, মেধার অধিকতর যাচাইয়ের জন্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। প্রশ্নও কঠিন হয়ে থাকে। বিশেষভাবে প্রস্তুতি না নেওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। আর আসন সীমিত হওয়ায় জিপিএ ৫ পাওয়া এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান না। তাই এসএসসি ও এইচএসসির মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।