১৯৫২-৫৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ঢাকার শিক্ষিত, রুচিবান, চাকরীজীবীরা মতবিনিময়, তর্ক-বিতর্কে অবসর কাটানোর জন্য সুন্দর পরিবেশের একটি স্থান বা বসার জায়গা পছন্দ করে নিয়েছিলেন। সেই স্থানটি হচ্ছে বাংলাবাজার এলাকায় অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং এন্ড রেস্টুরেন্ট।
অবস্থা ও পরিবেশগত কারণে অতিদ্রুতই বোর্ডিং এর রেস্টুরেন্ট অংশটি একটি আড্ডায় পরিণত হয়। আড্ডা শব্দটির মধ্যে একটি নেতিবাচক ও পরিতাজ্যিক সুর থাকলেও বিউটি বোর্ডিং এর আড্ডা ছিলো অনেক আলোকিত, শিক্ষণীয় বিষয়ে সমৃদ্ধ ও উন্নতমানের। মহল্লার ভেতরে অবস্থিত রেস্টুরেন্টটি মহল্লার সম্মানিতদের ছাড়াও মহল্লার বাইরের বিশিষ্টজনদের আকর্ষণ করতো। এই আকর্ষণ অনেককেই আবার নিয়মিত বা স্থায়ী অংশগ্রহণকারীতে পরিণত করেছিলো।
আড্ডার ব্যাপক পরিচিতির কারণে রেস্টুরেন্টটি পুলিশের নজরদারির মধ্যে ছিলো। তবে এই নজরদারি রেস্টুরেন্টে আড্ডার জৌলুস ও শিক্ষিত সুধীজনদের আসা কমাতে পারে নি।
বাংলাবাজার ও আশেপাশের এলাকার শিক্ষিত বয়স্ক তরুণরা নিয়মিতভাবে রেস্টুরেন্টে আসতেন, বিধায় আমি বা আমরা যারা স্থানীয়, সেই রেস্টুরেন্টে বসতাম না। তবে নিয়মিতভাবেই সেখানে বিভিন্ন কারণে যাতায়াত ছিলো। সেসময় জুনিয়র-সিনিয়র বিষয়টির ফারাক বিশেষভাবে মেনে চলা হতো। প্রয়োজনে রেস্টুরেন্ট থেকে চপ, কাটলেট ইত্যাদি কিনে এনে পাড়ারই কোনো বাড়িতে বা জুবিলী স্কুলের মাঠে বসে খেতাম।
জমিদার সুধীর বাবুর বিশাল বাড়ির পূর্বাংশের কিছু অংশ নিয়ে বিউটি বোর্ডিং এন্ড রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার আগে এই অংশটিতে একটি প্রিন্টিং প্রেস বা ছাপাখানা ছিলো, নাম সোনার বাংলা প্রেস। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দুই এক বছরের মাথায় এই প্রিন্টিং প্রেসটি উঠে যায়। বেশ কিছুদিন পর সেখানে একটি নতুন সাইনবোর্ড ‘বিউটি বোর্ডিং এন্ড রেস্টুরেন্ট’ স্থান পায়।
সময়টা খুব সম্ভব ১৯৫৩। জমিদার সুধীর বাবুর কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদে লিজ নিয়ে নলিনী মোহন সাহা (ভোন্দা) ও তার ভাই প্রহল্লাদ সাহা এই বোর্ডিং ও রেস্টুরেন্ট চালু করেন। তাদের এই উদ্যোগের সাথে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী ব্রজঘোষও ভূমিকা রেখেছিলেন বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, সোনার বাংলা প্রেস থেকে একটি পত্রিকা ছাপা হতো (দৈনিক নহে)। এ কারণে সেখানে বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনের আগমন ও আড্ডা তখনো হতো। তরুণ শিক্ষিত, শিক্ষক, ব্রহ্মসমাজের অনেকেই সেখানে আসতেন।
বোর্ডিং ও রেস্টুরেন্ট চালু হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই নিকটবর্তী বাসিন্দাদের অনেকেই সকাল-বিকাল চা-নাস্তা খেতে আসতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শহিদ কাদরী। তিনি ছিলেন লেখক ও কবি। পরে তিনিই নিয়মিতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে সৈয়দ সামসুল হক (কবি ও সাহিত্যিক) ফজল সাহাবুদ্দিন ও আরো অনেক সাহিত্যিকের আড্ডা গড়ে তোলেন। মাঝে মধ্যে শামসুর রাহমানও আসতেন। একদিন সিকান্দার আবু জাফরকেও রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে দেখেছি।
যদিও শহিদ কাদরীকে কেন্দ্র করে স্বল্পসময়েই একটা গভীর আড্ডা গড়ে ওঠে, কিন্তু রেস্টুরেন্টের নিয়মিত গ্রাহক, যারা এই এলাকা ও আশেপাশের বাসিন্দা ছিলেন, তাদের জমায়েত (একে আড্ডা বলা ঠিক হবে না) নিয়মিতই হতো এবং প্রতি রোববার তারা দীর্ঘসময়ের জন্য মিলিত হতেন। তাদের বন্ধু-বান্ধবরাও নগরীর দূর প্রান্ত থেকে আসতেন। গেন্ডারিয়া, আজিমপুর বা এলিফ্যান্ট রোড তাদের কাছে দূরবর্তী স্থান বলে মনে হতো না। তারা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, রুচিবান এবং দায়িত্বশীল চাকরীজীবী। এই আদি খদ্দেরদের মধ্য থেকে যাদের নাম স্মরণ করতে পারছি (তাদের সবার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে) তারা হলেন- নিখিল দা, তুষার দা, সালেহীন সাহেব, মোজাফফর হোসেন, সামসুদ্দোহা, সামসুদ্দোজা, আহসানুল্লাহ ভাই, রনজিৎ পাল চৌধুরী এবং হান্নান ভাই। একদিন ক্যাপ্টেন (অব.) হালিম চৌধুরীকেও দেখেছিলাম।
পরবর্তী সময়ে রেস্টুরেন্টের অন্য দুই টেবিলকে ঘিরেও আড্ডা গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মিন্টু ভাই, ব্রজেন দাস, সমর দাস, লতিফ ভাই, ইয়াকুব ভাই, বাদশাহ ভাই। প্রায় একই সময় তাদের সাথে যুক্ত হন সত্য দা, মনসুর ভাই, মোফাজ্জল হোসেন বিধু, শাহজাহান, জাহাঙ্গীর ভাই। অন্যদের নাম মনে করতে পারছি না। ষাটের দশকের শেষের দিকে কয়েকজন মধ্য পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীও আসতেন। তবে ফিরোজ কবীর (মুকুল সরকার) ব্যতীত তারা বিউটি বোর্ডিং এর আত্মার সাথে এক হতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়নি। ষাটের দশকের শেষের দিকে কিছু উদীয়মান কবি-সাহিত্যিকও আসা শুরু করেন। বিভিন্ন কারণে এ সময় সেই আড্ডার বা জমায়েতের মান নিম্নমুখী হয়।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের সময় সেনাবাহিনী বোর্ডিং ও হোটেলের মালিক (প্রহল্লাদ সাহা), কর্মচারী, অতিথিদের হত্যা করে। আশেপাশের বাড়ির বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায়, পরবর্তী নয় মাস বোর্ডিং ও রেস্টুরেন্টের পুরো কম্পাউন্ডটাই একটি ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরে বোর্ডিংটি আবার চালু করা হয়। প্রহল্লাদের দুই ছেলে তারক ও সমর উদ্যোগ নিয়ে এবং ব্রজঘোষের পরামর্শে সহযোদ্ধাদের সহায়তায় রেস্টুরেন্ট বাদ দিয়ে বোর্ডিং চালু করে। রেস্টুরেন্টের বড়ঘরটিকে কয়েকটি গেস্টরুমে পরিণত করে। অতি সম্প্রতি সামনের ছোট লনে ছাতা টানিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিউটি বোর্ডিং ও রেস্টুরেন্টকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। যদিও সেগুলোর অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত বা সম্পূর্ণ তথ্য ভিত্তিক নয়। এই রেস্টুরেন্টের শুরুতে যারা নিয়মিত আসতেন তারা সবাই গতায়ু। ষাটের দশকের শেষ পর্যায়ে যারা আসতেন তারা প্রায় সবাই উদীয়মান কবি বা সাহিত্যিক। এদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা রেস্টুরেন্ট সম্বন্ধে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ধারাবাহিকতা রাখতে পারেন নি। কারণে বা ঔৎসুক্য নিয়ে বিভিন্ন পেশার প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এখানে এসেছেন। তাদের সংখ্যা ২/৩শ হবে, কাজেই নামোল্লেখ সম্ভব নয়। এই বর্ণনা স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শীর, যিনি তখন একজন যুবক ছিলেন।
লেখক : মনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক