এক বছরে ৫৩২ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা - দৈনিকশিক্ষা

এক বছরে ৫৩২ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

সারাদেশে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।  

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন বা ৬৪ শতাংশই স্কুল পর্যায়ের। 

এছাড়া কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী এই এক বছর আত্মাহুতি দিয়েছেন বলে উঠে এসেছে আঁচলের সমীক্ষায়। 

শুক্রবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা: সমাধান কোন পথে?’  শীর্ষক এই সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। 

আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী জানান, দেশের দেড় শতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের তথ্য নেওয়া হয়েছে তাদের এই সমীক্ষায়। 

আত্মহত্যায় শীর্ষে ঢাকা 

দেশের আট বিভাগে আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে, যা মোট আত্মহত্যার প্রায় ২৩.৭৭ শতাংশ।

আত্মহত্যায় এগিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা 

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন বলছে, আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। 

আত্মহত্যা করা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩.৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৮৫ জনই মেয়ে; বাকি ১৬১ জন, অর্থাৎ ৩৬.১ শতাংশ ছেলে।

বয়ঃসন্ধিকালে ঝুঁকি বেশি 

সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। 

২০২২ খ্রিষ্টাব্দে যে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছে, তাদের মধ্যে ৪০৫ জন বা ৭৬.১২ শতাংশই টিন এজার। তাদের মধ্যে ৬৫.৯৩ শতাংশ মেয়ে; ৩৪.০৭ শতাংশ ছেলে। 

আবার আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের ৪৩ জন বা ৮.০৮ শতাংশের বয়স ছিল ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে ৪৬.৫২ শতাংশ মেয়ে। আর ছেলেদের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি, ৫৩.৪৮ শতাংশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়, সে কারণে ওই বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি।

আত্মহত্যার কারণ  

আঁচলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারী স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের তথ্যে জীবদ্দশায় তাদের নানা ধরের জটিলতার মুখোমুখি হওয়ার বিষয় এসেছে। সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এ পথ বেছে নিয়েছে ‘মান-অভিমান’ থেকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি।

তবে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে আরো বেশ কিছু বিষয় এসেছে প্রতিবেদনে। 

আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ায় ৪ জন, শিক্ষকের হাতে ‘অপমানিত’ হয়ে ৬ জন, গেইম খেলতে বাধা দেয়ায় ৭ জন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ২৭ জন, মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়ায় ১০ জন, মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে বলে তথ্য এসেছে সমীক্ষায়।

  আশা জাগাচ্ছে সরকারি পদক্ষেপ 

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটনার আশা জাগছে। এর মধ্যে একটি হল মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন। এছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক ফার্স্ট এইড (পার্ট-১)’ নামের একটি অনলাইন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২ এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। প্রত্যেক জেলায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জন্য একজন করে মনোবিদ নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন। ২০২৩ সালে ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির 'স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইটিতে মনের যত্ন নেওয়ার একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা তরুণ প্রজন্মকে মানসিকভাবে তৈরি হতে সহায়তা করতে পারে। 

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, শিশু কিশোরদের মন হয় ‘ভঙ্গুর প্রকৃতির’। এ বয়সে ছোট ছোট বিষয়গুলোও তাদের আন্দোলিত করে। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক বিকাশের সাথে অনেকেই খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতিও তাদের আত্মহত্যার মত বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।  

“আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষক এবং বাবা মায়েদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুকালে বাচ্চাদের উপর বাবা মায়ের প্রভাব যেমন বেশি থাকে, কৈশোরে সেই দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষকদের উপর। তাই শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনে তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যও বেশি। 

তিনি বলেন, স্কুল ও কলেজ শিক্ষকরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো শুনে মেন্টরের ভূমিকা পালন করতে পারেন। 

“আমাদের মনে রাখতে হবে, এই বয়সে একজন শিক্ষার্থীর সঠিক পরামর্শ পাওয়ার জায়গা অপ্রতুল।”  

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শাহরিনা ফেরদৌস সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের এই জরিপে দেখা যাচ্ছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা অনেক বেশি। 

“এ সময়ে কিশোর কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। রোগী দেখার সময় আমি দেখেছি, কোভিড-১৯ এর একটি বড় প্রভাব পড়েছে আমাদের কিশোর বয়সীদের ওপর, যা কাটিয়ে উঠতে এখনো আরো সময়ের প্রয়োজন। 

“সর্বোপরি বয়সন্ধিকালীন মনের যত্ন বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার সুযোগ ভীষণ প্রয়োজন। স্ক্রিন বা মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারিবারিক বন্ধন, পরিবারের সাথে ভালো সময় কাটানোর চর্চা বাড়াতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই আত্মবিশ্বাসী এবং সুস্থ মনন গড়ে তুলতে এই পদক্ষেপগুলো অনস্বীকার্য।”  

আঁচলের প্রস্তাব 

১. হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা। 

২. সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদেরকে সহানুভূতির সাথে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা।  

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ণে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। 

৪. স্কুল, কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন করা। 

৫. প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত করা। 

৬. স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান অনেকাংশে সম্ভব। এতে আর্থিক সংকটজনিত আত্মহত্যার হার কমে আসবে।  

৭. প্রেম-প্রণয় ঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে শাস্তি উল্লেখপূর্বক বিশেষ প্রচারণাভিযান পরিচালনা করা। 

৮. স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। এর মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। 

৯. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার খোলা। শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তির আওতায় এনে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ট্রেনিং দেওয়া।  

১০. কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।

১১. শিক্ষার্থীদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্য্যশীলতার পাঠ শেখানো। 

সংবাদ সম্মেলনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম, আঁচল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার সিয়াম উপস্থিত ছিলেন।

৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030930042266846