দেশের দুটি বেসরকারি ব্যাংকে অন্তত ২৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে জাল শিক্ষাগত সনদে চাকরি করার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংকেই জাল সনদে চাকরি করছেন ২৭ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সভায় আগামী ছয় মাসের মধ্যে সব ব্যাংকের কর্মীদের শিক্ষাসনদ যাচাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহককে কোনো প্রশ্ন না করার জন্যও ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। একইসঙ্গে এসএমই ও কৃষিঋণ বিতরণ জোরদার করা এবং আসন্ন রমজানে ডলার সংকটের অজুহাতে নিত্যপণ্যের এলসি জটিলতা তৈরি না করার জন্যও ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সভায় দেশের সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন।
একাধিক সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানায়, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) থেকে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ওপর বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মূলত ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতি, পদত্যাগ ও সার্ভিস বেনিফিট প্রদান না করা সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে এই পরিদর্শন করা হয়। এ সময় বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নথি পর্যালোচনায় ব্যাংকটির দুই কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র জাল মর্মে প্রমাণ পায় পরিদর্শক দল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই সনদগুলো যাচাই করার জন্য ব্যাংকটিকে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে ব্যাংকের নিজস্ব যাচাইয়েও শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জাল মর্মে প্রমাণ হয়। এর পর তাদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
পরবর্তী সময়ে আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দলের মৌখিক নির্দেশে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র যাচাইয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যা বর্তমানে চলমান। গত ১৪ জুলাই ওই ব্যাংকটি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়- তাদের অন্তত ২৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জাল প্রমাণ হয়েছে।
এ বিষয়ে গতকালের ব্যাংকার্স সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দুটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগকালে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র যথাযথভাবে যাচাই করা হয়নি মর্মে প্রতীয়মান হয়। একইভাবে অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃক নিয়োগ প্রদানকালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাইয়ে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তাই বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সকল বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগকালে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যথাযথভাবে যাচাইয়ের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় ব্যাংকিং খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং একটি সুষম প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ইতিপূর্বে যাচাই করা হয়নি, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে যাচাইয়ের জন্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃক যে কোনো পর্যায়ের নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের আগে আবশ্যিকভাবে উক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাইকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সভায় এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর এমডিদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
সভা শেষে সাংবাদিকদের বিফ্রি করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংকে জাল সনদে চাকরি করার তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকার্স সভায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে তাদের কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত সনদ যথাযথভাবে যাচাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
১০ লাখ টাকা জমার ক্ষেত্রে গ্রাহককে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, সম্প্রতি ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলে আমানতকারীদের ব্যাংকাররা বিভিন্ন প্রশ্ন করে টাকার উৎস জানতে চান। এতে গ্রাহকরা টাকা জমা দিতে গিয়ে জবাবদিহির মুখে পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তাই এখন থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা দিতে যাওয়া কোনো গ্রাহককে অতিরিক্ত প্রশ্নের মুখোমুখি না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হুন্ডি বন্ধ করার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে যাতে কোনো টাকা পাচার না হয়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি অব্যাহত রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়ম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেজবাউল হক বলেন, ঋণ অনিয়মের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করছে। এ তদন্ত শেষ হলে মূল ঘটনা জানা যাবে। তিনি জানান, ব্যাংকটির আমানত নিরাপদ রয়েছে। এক্ষেত্র গ্রাহকদের প্যানিকড (আতঙ্কগ্রস্ত) হওয়ার কিছু নেই।