এনটিআরসিএর স্বচ্ছ নিয়োগেও সৎ শিক্ষকের মহাসঙ্কট - দৈনিকশিক্ষা

এনটিআরসিএর স্বচ্ছ নিয়োগেও সৎ শিক্ষকের মহাসঙ্কট

সাবিহা সুমি, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

ঘুষ ও মামা-চাচাকে ধরাধরি ছাড়াই এন্ট্রি লেভেলের (সহকারি শিক্ষক, প্রভাষক, মৌলভী) শিক্ষক পদে নিয়োগ হচ্ছে। এসব শিক্ষক বাছাই করে দিচ্ছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। স্বচ্ছতার সঙ্গে গ্রাজুয়েট শিক্ষক নিয়োগের এই চর্চা দেশ ও জাতির জন্য নি:সন্দেহে অসীম আশা জাগানিয়া। কিন্তু, এই অসীম আশার গুঁড়ে বালি পড়ছে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের অস্বচ্ছ মানসিকতা ও অনিয়ম চর্চায়।  

আশা করা হয়েছিলো স্বচ্ছতার আনুকুল্য পাওয়া শিক্ষকরা কাজেও স্বচ্ছ থাকবেন।  মানসিকভাবেও তুলনামুলক সৎ থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী থাকবেন। কিন্তু সে প্রত্যাশা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে নবনিযুক্ত কিছু শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক পদে প্রার্থী বাছাইয়ের একক দায়িত্ব পায় এনটিআরসিএ। যৎ সামান্য বিসিএস পরীক্ষার আদলে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত বাছাই করা প্রার্থীদের। এতে ঘুষ কিংবা প্রশ্নফাঁসের কোনো অভিযোগ নেই। নতুন পদ্ধতিতে অদ্যাবধি এক লাখ বিশ হাজারের মতো শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। নিম্ন মাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি পর্যায় পর্যন্ত ত্রিশ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ, কারিগরি ও মাদরাসায় মোট শিক্ষক সংখ্যা চার লাখ ছুঁই ছুঁই। এর মধ্যে সরাসরি এনটিআরসিএ বাছাইকৃত ও নিয়োগকৃত এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক এক লাখ বিশ হাজার। বাদ বাকীরা পুরনো অর্থাৎ সরাসরি বেসরকারি ম্যানেজিং কমিটি কর্তৃক নেওয়া পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগকৃত। কিন্তু এনটিআরসিএ বাছাইকৃত শিক্ষকের একটা বড় অংশের মানসিক ও অর্থনৈতিক মানের বাজারে ঘি ও সয়াবিনের দামে, ঘ্রাণে ও চরিত্রে অনাকাঙ্খিতভাবে দারুন সাজুয্য! দৈনিক আমাদের বার্তার দীর্ঘ অনুসন্ধানে এমন আশাহত চিত্র উঠে এসেছে। যার অনিবার্য কুফল ভোগ করতে বাধ্য হবে মাধ্যমিক ও তদুর্ব্ধ শিক্ষাখাত। এর মাশুল হিসেবে পাবলিক পরীক্ষায় নিজ নিজ শিক্ষার্থীকে পাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আর ভোগান্তী পোহাতে হবে, নিজ নিজ বাড়ী থেকে দূরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছাতে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারকে ভরসা করে যেতে হবে ইউএনও কিংবা ওসি সাহেবের ওপর। নৈতিকতা বিবর্জিত এসব শিক্ষকের কারণে মাশুল গুণে যেতে হবে টাকার বিনিময়ে প্রশ্নফাঁসে শিক্ষকের জড়িত থাকার ঘটনাসমূহে। [সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের ছবি তোলা এক শিক্ষকের তিন মাসের কারাদণ্ড হয়েছে।] 

পুরনো এই ছবিটি ব্যবহার করে কিছু শিক্ষকের দাবি, গত ৩০ জুন তারা দেখা করেছেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। ফেসবুকে পোস্ট করার পাশাপাশি টাকা দিয়ে কিছু ভূঁইফোড় সংবাদ মাধ্যমেও এই ছবি ও এ বিষয়ক নিউজ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। এ হেন কাজকে প্রতিমন্ত্রী বলছেন, গুরুতর অপরাধ 

দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এনটিআরসিএ কর্তৃক বাছাইকৃত শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোতে কাজের জন্য ঘুষ দেন। সব মন্ত্রণালয় যেনো দুর্নীতির ব্যারাজ খুলে রেখেছে ----দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সাম্প্রতিক মন্তব্যকে সত্য প্রমাণে চাল-ডাল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও যুক্ত! মনে হতে পারে এমন অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে যেনো মরিয়া শিক্ষকদের একাংশ!   

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এক শ্রেণির শিক্ষক নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর নামেও অপপ্রচার করতে পিছ পা হন না। তাদের নিজেদের পছন্দের বাইরে শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা প্রশাসনের কেউ কোনো সুপারিশ করলে, উপদেশ বা পদক্ষেপ নিলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সভ্যতা বিবর্জিত মন্তব্য করতেও সবসময়ই সক্রিয়। শিক্ষকদের করা মন্তব্য দেখলে বোঝার উপায় নেই যে তারা সমাজের সবচেয়ে সম্মানীত অংশের প্রতিনিধি, শ্রেণিকক্ষে ও স্কুলের বাইরে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে মহান শিক্ষক। 

  
বেসরকারি শিক্ষকতার এমন চিত্রের খবরে বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদরা হতাশ। মন খারাপ করে তারা সুপারিশ করেছেন শিক্ষক পদে নিয়োগের আগে নৈতিক ও মানসিক সততার পরীক্ষা নেয়ার। এনটিআরসিএর আড়াই মিনিটের মৌখিক পরীক্ষা নয়। সপ্তাহব্যাপী বা মাসব্যাপী ডেমো ক্লাস, ফেসবুকের মাধ্যমে তার রুচি ও চিন্তা যাচাই করা, শিক্ষক পদে নিয়োগের পর বাধ্যতামূলকভাবে এথিকস ক্লাব গঠন করা ও সেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার পরীক্ষা। 

শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এমনটা চলতে থাকলে সরকারগুলো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তায় জেলা উপজেলার সিনিয়র প্রতিষ্ঠান প্রধান ডিঙ্গিয়ে তস্য জুনিয়র প্রশাসন ক্যাডার বা ওসি সাহেবের ওপর ভরসা খুঁজতেই থাকবেন। 

বর্ষীয়ান শিক্ষক নেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেন, এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। কারণ, এনটিআরসিএ কর্তৃক বাছাইকৃত ও সরাসরি নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃতদের মনোবল তুলনামূলক চাঙা থাকার কথা। যেহেতু তারা চাকরি জীবনের শুরুতে ম্যানেজিং কমিটিকে লাখ লাখ টাকা দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে যাননি। কাউকে ধরাধরি করতে হয়নি। ঘুষ ছাড়াই তারা মহান পেশায় ঢোকার সুযোগ পেয়েছেন,  সুতরাং তারা কেনো এমনটা করবেন?

দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে গত ১৪ মাস ধরে শিক্ষকদের একটা গ্রুপকে ভেতর ও বাইরে থেকে ফলো করে পাওয়া যায় মানসিক ও আর্থিক অসততার ডজন ডজন উদাহরণ। একটা গ্রুপের নেতা কত টাকা ঘুষ দিয়ে সচিবালয়ের পাস জোগাড় করেন। একটা আবেদন জমা দেওয়া, ফাইল উপরে ওঠানো, সুপারিশ করানো ও সিদ্ধান্তের কপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করানো অব্দি কোন কোন কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে কি কি দিলেন তার মোটামুটি একটা চিত্র পাওয়া গেছে। আবার গ্রুপে নোটিশের মাধ্যমে টাকা-পয়সা তোলা ও তার খরচ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদের তথ্যও পাওয়া গেছে। এসব তথ্য-উপাত্ত দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে রয়েছে। 

সর্বশেষ ঘটনা শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন নাহারকে নিয়ে। এনটিআরসিএ বাছাই করা ও নিয়োগের সুপারিশ পেয়ে শিক্ষক হিসেবে বিনাঘুষে নিয়োগ পেয়েছেন এমন কয়েকজন শিক্ষক রীতিমতো প্রতিমন্ত্রীকে বিক্রি করে দিয়েছেন! বদলি প্রত্যাশী শিক্ষক ব্যানার তৈরি করে তারা একটা ছবি ব্যবহার করছেন। এই ব্যনারের অধীনস্ত শিক্ষকরা দাবি করছেন গত ৩০ জুন প্রতিমন্ত্রীর সচিবালয়ে ফুল দিয়েছেন এবং বদলির বিষয়ে আবেদন জমা দিয়েছেন। তারা দাবি করছেন যে, ‘প্রতিমন্ত্রী মহোদয় আমাদের দাবির বিষয়ে পজেটিভ’। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই শিক্ষকরা টাকা দিয়ে কয়েকটি ইউটিউবার ও ভুইফোঁড় অনলাইন পত্রিকায় প্রতিবেদনও প্রকাশ করিয়েছেন। 

দৈনিক আমাদের বার্তার এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘৩০ জুন আমার সঙ্গে কেউ দেখা করেনি। বদলি নিয়ে কোনো কথা হয়নি কারো সঙ্গেই। ওইদিন আমি সকাল দশটা থেকে রাত ১১টা অব্দি জাতীয় সংসদে ছিলাম। যেসব শিক্ষক দাবি করছেন আমার সঙ্গে তারা সচিবালয়ে দেখা করে ফুলের শুভেচ্ছা দিয়েছেন তারা গুরুতর অপরাধ করছেন।’ 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

সরকারি খরচে বন্ধ বিদেশ ভ্রমণ, কেনা যাবে না গাড়ি - dainik shiksha সরকারি খরচে বন্ধ বিদেশ ভ্রমণ, কেনা যাবে না গাড়ি চাচাতো বোনকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে - dainik shiksha চাচাতো বোনকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ছাত্রলীগের সভাপতির বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ গতিশীল করতে এনটিআরসিএকে নির্দেশ - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ গতিশীল করতে এনটিআরসিএকে নির্দেশ শিক্ষক সমিতির নেতার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষক সমিতির নেতার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ছড়ালে ব্যবস্থা - dainik shiksha মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র ছড়ালে ব্যবস্থা কোটা নিয়ে এতো কীসের আন্দোলন: প্রধান বিচারপতি - dainik shiksha কোটা নিয়ে এতো কীসের আন্দোলন: প্রধান বিচারপতি কোটা আন্দোলন: বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক - dainik shiksha কোটা আন্দোলন: বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক সর্বজনীন পেনশন বাতিল দাবিতে শিক্ষকদের চতুর্থ দিনের কর্মবিরতি চলছে - dainik shiksha সর্বজনীন পেনশন বাতিল দাবিতে শিক্ষকদের চতুর্থ দিনের কর্মবিরতি চলছে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034708976745605