মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য ৩০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে চার শতাধিক স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশব্লক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ছয় মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে ২০১২ সাল থেকে শুরু হয় প্রকল্প। কিছু স্কুলে কাজ শেষে ওয়াশব্লক হস্তান্তর করা হলেও সেগুলো নিয়ে রয়েছে নানান অভিযোগ। কয়েকটিতে করোনা মহামারীর আগে শুরু হওয়ায় নির্মাণকাজ এখনো চলছে। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ওঠায় কাজ বন্ধ রেখেছেন কয়েকজন ঠিকাদার। অনেক ওয়াশব্লকে একটি বা দুটি ছাদ ঢালাই দিয়েই ঠিকাদার উধাও! স্কুল বন্ধ থাকলে নির্মাণাধীন এসব ওয়াশব্লক মাদকসেবীদের আড্ডাখানায় পরিণত হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘ সময়েও প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে শেষ না হওয়া এর সুফল পাচ্ছে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
যেসব জায়গায় প্রকল্প : মাদারীপুর সদর, রাজৈর, শিবচর, কালকিনি ও ডাসার (নতুন উপজেলা) এই পাঁচ উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৭১৯টি। এর মধ্যে ৪৩৬টি স্কুলে ওয়াশব্লক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ৩০৫ কোটি ৬২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৮ টাকা। কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় মাদারীপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
মাদারীপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (জিপিএস) ওয়াশব্লক নির্মাণকাজ হাতে নেওয়া হয় ৩৮টি, যার প্রতিটির খরচ ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৮৪৪ টাকা ৫২ পয়সা। নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (এনএনজিপিএস) তৈরি করা হচ্ছে পুরো জেলায় ২৭টি, যার খরচ প্রতিটির ১৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৬ টাকা ৪৪ পয়সা। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি বা পিইডিপি-৪-এর আওতায় পুরো জেলায় বিভিন্ন স্কুলে ওয়াশব্লক তৈরি হয়েছে ৬৭টি, যার প্রতিটির খরচ ১৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া পিইডিপি-৩, যার কাজ অনেক আগেই সমাপ্ত হয়েছে; তবে সেই ওয়াশব্লকগুলো একই ছাদের নিচে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা। এই প্রকল্পে পুরো জেলায় ছেলেদের জন্য ১৩৪ ও মেয়েদের জন্য ১৭৪টি ওয়াশব্লক, যার প্রতিটির খরচ ৩ লাখ ৮৬৬ টাকা করে।
জানা গেছে, পিইডিপি-৩-এর আওতায় কাজ শুরু হয় ২০১২ থেকে ২০১৩ সালে এবং শেষ হয় ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা জিপিএস ও নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা এনএনজিপিএসের আওতায় ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে কাজ শুরু হয় এবং এখনো চলমান। পিইডিপি-৪-এর কাজ শুরু হয় ২০১৯-২০ সালে, সেই কাজও চলছে।
জানা গেছে, মোট ১১৬টি ওয়াশব্লকের কাজ তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসের সূত্র অনুযায়ী, যে কাজগুলো চলমান রয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগ বন্ধ রয়েছে করোনা মহামারীর পর থেকে। ঠিকাদারদের বারবার বলার পরও কাজ হচ্ছে না।
যা থাকার কথা
প্রকল্প অনুযায়ী, প্রতিটি ওয়াশব্লক ২৬ ফুট দীর্ঘ ও ১৩ ফুট প্রস্থের হওয়ার কথা। আধুনিক ওয়াশব্লকে উন্নতমানের দুটি কমোড, চারটি সাধারণ প্যান, দুটি বেসিন, দুটি প্রস্রাবখানা, দুটি ফুটওয়াশ, সাবমারসিবল পাম্পসহ পানির ট্যাংক, সেপটিক ট্যাংক এবং ভেতরে পুরোটাই উন্নতমানের টাইলসযুক্ত হওয়ার কথা। ভেতরে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ফিটিংস ও সরঞ্জাম থাকার কথা।
সরেজমিনে ওয়াশব্লক
পাঁচ উপজেলার ২০টি সরকারি ও নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পিইডিপি-৩-এর আওতায় যেসব স্কুলে ওয়াশব্লক নির্মাণ করা হচ্ছিল, সেগুলো বেশ আগেই হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে সেগুলোর বেশিরভাই অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর। কয়েকটি স্কুলে ওয়াশব্লক নিয়ে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী (ইট, কংকর, রড) ব্যবহার; জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর অনুপস্থিতিতে বেইজ, পিলার ও ছাদ ঢালাই; নকশা মোতাবেক কাজ না করা; সময়মতো কিউরিং (পানি দিয়ে ভেজানো) করা হয়নি।
রাজৈর উপজেলার আলমদস্তা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ শেষ করা ওয়াশব্লকে গিয়ে দেখা যায়, কমোড ভাঙা, ফ্লাশ অকেজো, কিছু স্থানে ভাঙা টাইলস লাগানো, সাবানদানির কারণে পানির কল চালানোয় অসুবিধা, দরজার কারণে হাই কমোডে যাওয়ায় অসুবিধা, প্রস্রাবখানা উল্টো দিকে বসানো। টাইলসের ফ্লোরে পানি জমে আছে।
মাদারীপুর সদর উপজেলার ‘উত্তরঝিকরহাটি ও পশ্চিম ঘটমাঝি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর সহকারী শিক্ষক মাসুদা খানম বলেন, ‘আমি স্কুলে আসি সকাল ৮টার মধ্যে। সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আমাদের স্কুলে থাকতে হয়। স্কুলে ওয়াশরুম থাকতেও আমাদের অন্যের বাড়িতে যেতে হয়। এতে তারা বিরক্ত হয়। কী করব। এরপরও যেতে হয়।’
রাজৈর উপজেলার সামছুল হক মোল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন বছর আগে ওয়াশব্লকের কাজ শুরু হয়। কিন্তু একটি ছাদ ও চারটি পিলার ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এ কাজ শেষ না করায় অন্য কোনো ওয়াশব্লক তৈরির সুযোগও হচ্ছে না। সেখানে পানি জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে; মশা-পোকামাকড় জন্ম নিচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে ওয়াশব্লকের ভবন আছে কিন্তু এর কোনো সুবিধা নিতে পারছে না পশ্চিম শ্রীনাথদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া টেকেরহাট পুপলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ওয়াশব্লকের কাজ কোনো রকম করে শেষ করা হয়েছে। এখন চলছে রঙের কাজ। তবে শিক্ষকদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কমোড, সাধারণ প্যান, প্রস্রাবখানা সবই উল্টো লাগানো হয়েছে (পশ্চিমমুখী করে; মুসলিমপ্রধান দেশে যেটা করা হয় না)।
উত্তরঝিকরহাটি ও পশ্চিম ঘটমাঝি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সাফিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্কুলে তিন বছর আগে কাজ শুরু হয়েছে। তারা আড়াই বছর ধরে একটু একটু করে কাজ করেছে। তারপরও সুন্দর করে কাজগুলো করে নাই। কমোডের ফ্লাশ, বেসিনের কল কাজ করে না। গ্লাস ভেঙে পড়েছে, পেছনের ট্যাংক ভেঙে পড়েছে। মূল ওয়াশব্লকে পানির সংযোগও দেওয়া হয় নাই। আমাদের ওয়াশব্লকের সঙ্গে একটি গভীর নলকূপ দেওয়ার কথা, সেটাও দেয়নি। তারা যে কাজ করে চলে গেছে, সেটা আমাকে বুঝিয়েও দিয়ে যায়নি। আমার কাছ থেকে কোনো ধরনের স্বাক্ষর নেয়নি। আমি একাধিকবার পাবলিক হেলথে জানিয়েছি! আমাদের শিক্ষা অফিসেও জানিয়েছি! কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের ও ছাত্রছাত্রীদের অনেক কষ্ট হয়। অন্যের বাড়িতে যেতে হয়। তারা অনেক কথা শোনায়। কী আর করার? তারপরও যেতে হয়।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অন্যের বাড়িতে গেলে অনেক সময় তাদের কাছ থেকে নানান কথা শুনতে হয়। অনেক সময় তারা বাথরুম চেপে রাখে, বাসায় গিয়ে সারে। এতে তাদের অনেক কষ্ট হয়। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে।
অন্য আরেকটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা বলে, তাদের নামেমাত্র ওয়াশব্লক। অনেক পুরনো একটি শৌচাগার, যেটা ছেলে ও মেয়েরা সবাই ব্যবহার করে। অনেক সময় এতটাই অপরিষ্কার থাকে যে আশপাশেই যাওয়া যায় না।
ডাসার উপজেলার পূর্ব মাইজপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পিইডিপি-৩ প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল চলছে, কিন্তু ওয়াশব্লক তালাবদ্ধ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. শাহজালাল মিয়ার যুক্তি, স্কুলের শৌচাগার অন্যরা ব্যবহার করে, তাই তালা মারা থাকে। যখন যার প্রয়োজন হয়, চাবি নিয়ে যায়। না করা যায় না। এতে ছোট ছোট শিক্ষার্থীর অনেক কষ্ট হয়।
শিক্ষা অফিস থেকেও অভিযোগ
জানতে চাইলে রাজৈর উপজেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যে স্কুলগুলো ভিজিট করেছি, এর মধ্যে ১৫টির কাজ মোটামুটি সন্তোষজনক। বাকিগুলোর কাজ চলমান থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগই বন্ধ আছে দীর্ঘদিন।’
শিবচর উপজেলা শিক্ষা অফিসার মুন্সী রুহুল আসলাম বলেন, ‘এখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২৪টি, জাতীয়করণ করা বিদ্যালয় ৫৬টি। এই ১৮০টি স্কুলের সবগুলোতে ওয়াশব্লক তৈরির প্রস্তাব পাঠাই। সেখানে ১১০টির প্রস্তাব পাস হয়ে ১০৪টির কাজ হচ্ছে। আর নদীভাঙনকবলিত এলাকায় ওয়াশব্লক হচ্ছে না। কারণ সেখানে স্কুলভবনই নাই।’
কালকিনি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বদিউজ্জামান জানান, তার উপজেলায় মোট বিদ্যালয় ১৯৯টি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক ১২২টি, নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৭টি। এগুলোর মধ্যে ওয়াশব্লকের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল ৪৮টির, সবগুলোই পাস হয়েছে। এর মধ্যে ২৪টির কাজ চলমান রয়েছে এবং কাজ শেষে ব্যবহার হচ্ছে ২৪টি। যেগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে, সেগুলো মানের দিক থেকে মোটামুটি।
ঠিকাদারপক্ষের যুক্তি
ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে এলাকায় তারা কাজ করেন, সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হয়; কাজের টাকার অঙ্ক থেকে তাদের ২ থেকে ৩ শতাংশ দিতে হয়। আবার বিল পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ভিজিটে ও বিভিন্ন দিবসে তদারককারী কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ করতে হয়। সব মিলিয়ে বরাদ্দের একটা বড় অংশ চলে যায়। এসব কারণেই প্রকল্পে অনিয়ম বেশি হয়। বরাদ্দের সব টাকা হাতে আসবে না জেনে তারা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার।
জনস্বাস্থ্য বিভাগের ভাষ্য
মাদারীপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, টেন্ডার হওয়ার পরে ছয় মাসের ভেতরে কাজ সমাপ্ত করে হস্তান্তর করার কথা বলা আছে। এর মধ্যে যদি কেউ কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় বা হস্তান্তর করা না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা কাজগুলো অসম্পূর্ণ রেখেছে, তাদের জরিমানা করা হবে এবং সেই কাজের নতুন করে টেন্ডার দেওয়া হবে। এ ছাড়া তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হবে।