কতো দূর এগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা?
এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বায়ান্ন বছর পার হয়েছে একটি দেশ ও জাতির জীবনে। এই অর্ধ শতাব্দিরও বেশি সময়ে উদার আকাশ আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যদি মূল্যায়ন করা হয়, যে শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বিশ শতকের ষাটের দশকে ছাত্রসমাজ আন্দোলন সংগ্রাম, অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সেই ব্যবস্থা কী একটি স্বাধীন, সার্বভৌম নতুন দেশে প্রচলিত হতে পেরেছে, যথাযথ জবাব পাওয়া ভারী মুশকিল।
মাস কয়েক আগে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শিক্ষাঙ্গন তথা শিক্ষা ব্যবস্থার যে চিত্র বিধৃত করেছেন, তাতে ফুটে উঠেছে শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বশেষ হাল হকিকত। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি যখন কথাগুলো উচ্চারণ করেন, তখন তা গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। পতনে-উত্থানে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে পুরো ব্যবস্থাটি, তার ব্যবচ্ছেদ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, সার্বিক শিক্ষার অবস্থা যুগোপযোগী হয়ে ওঠার পরিবর্তে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভুবনের ভার বহনের কাজে ব্যাপৃত যেনো। রাষ্ট্রপতি শুধু শিক্ষা নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমকালীন পরিস্থিতির অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটিও তুলে ধরেছেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাঙ্গন নিয়ে যে ব্যবস্থা চলমান, তার ভেতরের অন্ত:সার শূন্যতাকে তিনি প্রকটিত করেছেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ, হানাহানি, হত্যাযজ্ঞ, নানাবিধ নিপীড়ন, অসহিষ্ণুতা, আর্থিক বিশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি দিনে দিনে গড়ে উঠেছে, তা দেশ ও সমাজকে কলুষিত করে তুলেছে। জনকল্যাণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীভূত করা এখনও দুঃসাধ্য যেনো। আলোকিত মানুষ, আলোকিত সমাজ, আলোকিত দেশ ও জাতির বিকশিত হবার ক্ষেত্রগুলো যদি হয় সংকুচিত, তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ ঝরঝরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একমুখী শিক্ষা চালু করার বিধান রাখা হয়েছিল সেখানে। সেই কমিশনের সুপারিশগুলো ছিল যুগোপযোগী। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কমিশনের রিপোর্ট ফাইলবন্দি হয়ে যায়। পরবর্তী সামরিক শাসকরাও শিক্ষা কমিশন করে। যায় লক্ষ্যই ছিল শিক্ষাকে সংকুচিত করা। এবং তাতে তারা সফলও হয়েছে। এরশাদ গঠিত মজিদ খান কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সারাদেশে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠেছিলো। আর একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। সামরিক সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূলক সংস্কারের কাজ আর হয়নি। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, এই নীতি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। যদিও এই নীতিতে ঘাটতি রয়েছে এমন কথাও উঠেছিল। তবে এই নীতি যে সর্বক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়েছে তা নয়। নানা সময়ে নানা রকম পথ ও পদ্ধতি চালু করা হলেও অনেকগুলোই সুফল নিয়ে আসতে পারেনি।
বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় যে, শিক্ষা সংস্কার জরুরি। এর জন্য প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ও যাত্রা নিয়ে এগোনো প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যতো আলোচনা-সমালোচনা হয় ততোই এর ত্রুটি ও বিচ্যুতি বিকৃতির দিকগুলো প্রতিভাত হবে।
দেশজুড়ে এখন মধ্য মেধাবী তথা ‘মিডিওকারের’ জয়জয়কার। মেধাবী পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশপ্রেম স্বজাত্যবোধ ও সুনাগরিকের গুণাবলী ও জ্ঞান অর্জন মিডিওকারের পক্ষে দুরূহ প্রায়। দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা এতোটাই পরীক্ষা নির্ভর হয়ে পড়েছে যে, সুকুমার বৃত্তির চর্চা আর হয় না। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা এই দুরবস্থা ঘটিয়েছে। ফলে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক ইত্যাকার বিষয়গুলোর বিস্তার ঘটছে।
প্রথম শ্রেণি থেকে যে কোচিং সেন্টারমুখী হন শিক্ষার্থীরা, সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও। ক্লাসরুমে আর তেমন পাঠদান হয় না বা করানো হয় না। শিক্ষকরা ব্যস্ত কোচিং সেন্টারে। অধিক আয়ের লোভের বশবর্তী হয়ে তারা কোচিংমুখী হন। এমনিতে দেশে বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলা জানেন না। দুএকটি ব্যতিক্রম বাদে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয় না। মাতৃভাষায় শিক্ষার আলো প্রতিফলিত হয় না এসব শিক্ষার্থীর জীবনে। মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের কথা বলা হলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। সন্তানদের বিদেশমুখী করার জন্য ইংরেজি মাধ্যমের প্রসার ঘটাতে বিত্তবানরা সচেষ্ট। দেশপ্রেম এখানে বাহুল্য মাত্র। দেশে পেশামূলক শিক্ষার বিস্তার ঘটেনি। এমন অনেক বিষয় পড়ানো হয়, যার কার্যত আর্থিক মূল্য নেই। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহারও নেই।
শিক্ষানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন করা না গেলে শিক্ষাক্ষেত্রে অরাজক অবস্থা বিলীন না হয়ে বরং আরো বেশী বিস্তৃত হবে। তাই যুগোপযোগী শিক্ষার প্রসার জরুরি। বিভিন্ন ধারার পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যম বৃহত্তম সংখ্যক যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত চরিত্রবান সম্পন্ন কর্মী তৈরি যে জরুরি, সে নিয়ে কোন পরিকল্পনা চোখে পড়ে না।
বায়ান্ন বছরে আমাদের দেশের অনেক অগ্রগতি হলেও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের এই যুগেও শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক সংস্কার ঘটেনি। উন্নয়নের ধারা প্রবহমান সর্বত্র। শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে তা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অজস্র গড়ে উঠেছে, শিক্ষার্থী বাড়ছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষার উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা ও যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য উপযোগী শিক্ষিত লোক তৈরি গুরুত্ববহন করলেও বাস্তবতায় তার দেখা মেলে না! দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হচ্ছে বয়স্করাও। কিন্তু সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্পন্ন বলা যাবে না। এই অন্ধকারকে দূর করে আলোর ঝর্ণাধারার প্রবাহ বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট হবার বিকল্প নেই।
লেখক : জাফর ওয়াজেদ, মহাপরিচালক, পিআইবি
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।