আজ ৫ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বই এমন একটি উপকরণ, যা একজন মানুষকে সহজেই আলোকিত করে তুলতে পারে। আপনজন পর হতে পারে কিন্তু বই কখনো পর হয় না। শিক্ষার আলো, নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সবকিছুই রয়েছে বইয়ের ভেতর। জ্ঞানের উৎস বই আর বইয়ের মধ্যেই আছে সব ধরনের জ্ঞান। তাই জীবনের জন্য বই প্রয়োজন। মানুষের জীবনের একঘেয়েমি, দুঃখ-কষ্ট, অস্থিরতা, মানসিক সমস্যাসহ নানা সমস্যা দূর করতে প্রয়োজন বই।
অবসরে বিনোদনের মাধ্যমে কাটানোর জন্য কতো কিছুই না আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু বই পড়ার মতো নির্মল আনন্দের সমতুল্য আর কিছু হতে পারে না।
বাঙালির প্রাণের মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসজুড়েই চলে প্রাণের বইমেলা। আর ঠিক এ মাসেই পালিত হয় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। তাই ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য এক অনন্য মাস। গ্রন্থাগার পেশাজীবী, প্রকাশক ও পাঠকদের দীর্ঘদিনের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বর্তমান সরকার। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিলো। তাই এ দিনটিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস, হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রন্থাগারকে জনপ্রিয় করা, গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর জাতির গ্রন্থাগার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘গ্রন্থাগারে বই পড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি’।
বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’র পরিকল্পনা এখন বাস্তবরূপ। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ তথা দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে আবার সরকার গঠন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এবার ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধনের সময় তাই ছাপা বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল বই প্রকাশের কথাও বলেছেন এবং এর মাধ্যমে দেশের বই যাতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে।
জ্ঞানের আধার হলো বই, আর বইয়ের আবাসস্থল গ্রন্থাগার। জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অতুলনীয়। বাংলাদেশ এবং বাঙালির ঐতিহ্য সেই প্রাচীনকাল থেকেই পুঁথি সংরক্ষণের প্রথা। এখনো বইপ্রেমী মানুষের কাছে একটা গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার পরম সম্পদ। প্রাচীনকালে পুঁথি লেখা হতো তালপাতায়, গাছের বাকলে, পশুর চামড়ায়, আবার কখনো পাথরে ও টেরাকোটা পদ্ধতিতে। সাধারণত এই পুঁথিগুলো সংরক্ষণ করা হতো বিভিন্ন ধর্মগৃহে, বিহারে বা উপসনালয়ে। প্রথম গ্রন্থাগারের ধারণা শুরু করা হয়েছিলো প্রাচীন মিশরে। তখন উপাসনার পাশাপাশি তাত্ত্বিক আলোচনা বা জ্ঞান প্রসারের জন্য পুরোহিতদের নিজেদের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বা তথ্য সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়। আর এ কারণেই মিসরের এক মন্দিরে শুরু করা হয় গ্রন্থাগার।
বিশ্বসভ্যতার অগ্রসর হওয়ার পথে মানুষ তার সৃষ্টিকে সংরক্ষণ করা শুরু করলো। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, ইরাকের বাগদাদ, দামেস্ক, প্রাচীন গ্রীস ও রোমে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের নিদর্শন পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের তক্ষশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীব সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
গ্রন্থাগারের ইতিহাস অনেক পুরনো। আব্বাসীয় ও উমাইয়া শাসনামলে ‘দারুল হিকমা’ নামক গ্রন্থাগার ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে। সমকালীন মিশরের ‘বাইতুল হিকমা’ও জ্ঞান বিতরণে ভূমিকা পালন করেছে। সব যুগেই গ্রন্থাগারগুলো গড়ে ওঠে মূলত রাজদরবার ও ধর্মীয় উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহের মধ্যে প্রথমেই আসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে’র নাম। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত এ লাইব্রেরিতে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি বইয়ের সমাহার। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামও পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থাগারের মধ্যে অন্যতম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বডলিন লাইব্রেরি’তেও রয়েছে ১ কোটির অধিক বই।
অন্যদিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম লাইব্রেরির মধ্যে রয়েছে ‘ভ্যাটিকান লাইব্রেরি’। এ গ্রন্থাগার আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে একটি এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংগ্রহগুলোর মধ্যে একটি রয়েছে৷ এটিতে সমগ্র ইতিহাস থেকে ৭৫ হাজার কোডিস রয়েছে। একইসঙ্গে ১১ লাখ মুদ্রিত বই। এ ছাড়াও ফ্রান্সের বিবলিওথিক লাইব্রেরি, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি ও কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিও পৃথিবীর প্রাচীন লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম। যেটি একসময় পৃথিবীর সপ্তাচার্যের মধ্যেও ছিলো।
গ্রন্থাগারের ননা ধরন রয়েছে। এর বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে জাতীয় গ্রন্থাগার অন্যতম। জাতীয় গ্রন্থাগার সাধারণত দেশের সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। জাতীয় পর্যায়ের গ্রন্থাগার অন্য আর দশটি অনুরূপ প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জাতীয় গ্রন্থাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার সংগ্রহের পরিধি জাতীয়ভিত্তিক, গুরুত্ব আন্তর্জাতিক এবং দেশ ও জাতি সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সকল প্রকাশনা সংগ্রহ করে জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ৫ লাখেরও অধিক বইয়ের সংগ্রহশালা রয়েছে। এ ছাড়াও ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং আঞ্চলিকসহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা রয়েছে এ গ্রন্থাগারে। তবে দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এ দিবস সম্পর্কে অবগত নন। এ দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য কী সে সম্পর্কে দেশের মানুষ এখনো জানেন না। এর পেছনে অবশ্য সাধারণ মানুষকে তেমন দায়ী করা চলে না। কারণ, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা হয়তো বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেন না। দেশের বর্তমান ও নতুন প্রজন্ম দিনদিন নিজেদেরকে বই থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। নতুন প্রজন্ম বইয়ের পাতার চেয়ে মোবাইল স্ক্রিনই বেশি পছন্দ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নেই বইপড়ার চর্চা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা। নেই বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ।
জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন ব্যতীত রাষ্ট্র, সমাজ তথা আমাদের পরিপূর্ণ মুক্তি যেমন অসম্ভব তেমনি সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। আমরা শঙ্কিত যে সৃজনশীলতা বিবর্জিত একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে। এ প্রজন্ম পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবার জন্যই কল্যাণকর নয়। জাতি ও সমাজ গঠনে নতুন প্রজন্মকে নতুন উদ্যমে বইমুখী করার উদ্যোগ নিতে হবে।
গ্রন্থাগার আমাদের আলোর পথের নীরব জ্ঞানভাণ্ডার। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির বিকল্প নেই। শূন্যতায় হাহাকার করা গ্রন্থাগারগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় আমাদের জ্ঞানচর্চার, মুক্তচিন্তার দৈন্যদশা। জ্ঞান, বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য গ্রন্থাগারগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। পুরোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে গ্রন্থাগারগুলোকে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সদ্য শেষ হওয়া মেয়াদে অনেক দেশের নানা প্রান্তে এ পর্যন্ত ২৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করেছেন। সারা দেশে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মোট ৫৬৪টি মডেল মসজিদ করবে সরকার। এ আদলে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে মডেল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটেছে কম না। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও মননশীলতার কি সে ধরনের কোনো উন্নয়ন বা ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন হয়েছে? অথচ সাংস্কৃতিক জাগরণ ও মননশীলতার উন্নয়ন ব্যতীত জাতির সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণ মুক্তি সম্ভব নয়। আর এ মননশীলতার উন্নয়নই জাতি গঠনে বড় ভূমিকা বাখতে পারে।
বাংলাদেশের জন্ম অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার এ দীর্ঘ বছরে দেশে অনেক কিছুই ‘মডেল’ হয়েছে। শুধু মডেল হতে পারেনি জাতির জ্ঞানভাণ্ডার, গ্রন্থাগার। মডেল স্কুল-কলেজ, মডেল মসজিদসহ আরো অনেক কিছু মডেল করা হয়েছে। কিন্তু দেশে একটিও মডেল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে কি? গ্রন্থাগার হলো ‘লাইটহাউস’। আমরা আমাদের এ বাতিঘরকে যেনো দিন দিন নিভিয়ে ফেলছি। আমাদের প্রিয় এ দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে, একটি সৃজনশীল প্রজন্ম ও মননশীল জাতি গড়ে তুলতে হলে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি এলাকায় মডেল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করতে পারলে সেটাই হবে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের সার্থকতা।
লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা