কর্মকর্তাদের অদক্ষতায় শিক্ষার প্রকল্পের ১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি - দৈনিকশিক্ষা

কর্মকর্তাদের অদক্ষতায় শিক্ষার প্রকল্পের ১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষার ৭৩টি প্রকল্পের এক হাজার তিনশ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। এর মধ্যে সাত প্রকল্পেই প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা অব্যয়িত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ‘অদক্ষতা’, ‘গাফিলতি’ এবং প্রকল্প দলিল (ডিপিপি) সংক্রান্ত ‘জটিলতার’ কারণে এ অর্থ ব্যয় হয়নি বলে প্রকল্প বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রাকিব উদ্দিন। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ৭৩টি প্রকল্পের মধ্যে অন্তত ২৩টিতে ‘পূর্ণকালীন’ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ না দিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সংস্থা প্রধানরা ‘পিডি’র দায়িত্ব ধরে রেখেছেন। এ কারণে অধীনস্থ কর্মকর্তারা ‘স্বাধীনভাবে’ দায়িত্বপালন করতে পারছেন না। যার ফলে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। 

এ নিয়ে সম্প্রতি অন্তত তিন দফায় প্রকল্প পরিচালক ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শিক্ষামন্ত্রী যথাসময়ে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারায় সভায় ‘তীব্র অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন বলে সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সভায় সচিব সোলেমান খান শিক্ষার সব প্রকল্পের এক বছরের আর্থিক বিবরণী, বার্ষিক প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান এবং বরাদ্দকৃত টাকা অব্যয়িত থাকার কারণ জানতে চান। ওই সভায় বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ্য থেকে দাবি করা হয়, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পের তথ্য নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। ইউজিসি বারবার চিঠি দিয়েও তথ্য পাচ্ছে না। আবার বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ‘পিডি’র কর্তৃত্ব ধরে রাখার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে বলে সভায় অভিযোগ করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে ওই প্রকল্পের জন্য পূর্ণকালীন পিডি থাকতে হয়। কিন্তু অনেক বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকল্পের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দু-একটি ক্ষেত্রে উপাচার্যরাও আলাদা পিডি নিয়োগ না দিয়ে নিজেরাই প্রকল্প চালাতে চান। এ কারণে প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পিডি নিয়োগের জন্য নূন্যতম তিনজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক বা কর্মকর্তার একটি প্যানেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠাতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই প্যানেল থেকে একজনকে পিডি নিয়োগ দেয় শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি।’

এছাড়া বর্তমানে অনেক বিশ^বিদ্যালয়ে অবকাঠামো নির্মাণকাজ ২০১৮ সালে নির্ধারিত ‘রেট’ বা বাজার দর অনুযায়ী হচ্ছে জানিয়ে ইউজিসি সচিব বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে ২০২৩-এই সময়ে প্রায় সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর দাম অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে অনেক ঠিকাদার কাজ নিয়েও তা সারেন্ডার করছেন। এ ক্ষেত্রে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকছে না।’

মোট প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৫০ কোটি টাকা ও তার অধিক অর্থ ব্যয় না করা প্রকল্প ছয়টি। এর মধ্যে ‘জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আরএডিপিতে (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বরাদ্দ ছিল ২৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অব্যয়িত রয়েছে ১৫৯ কোটি টাকা।

জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন হওয়া ‘কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে’ বিদায়ী অর্থ বছরে ২৬০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১৩০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়নি।

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ’ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরএডিপিতে ১৩২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১২৮ কোটি ২১ লাখ টাকাই অব্যয়িত রয়েছে।

‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (আইইআইএমএস) প্রকল্পে বিদায়ী অর্থবছরে আরডিপিতে ২০৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যে ১২৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকাই ব্যয় হয়নি। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ১৮৮ একর জমিতে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর সেখানে জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। একই বছরের ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবরে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনা মহামারীসহ নানা কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়।

ইউজিসি থেকে জানা গেছে, নীল সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ২০১৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক স্থাপন আইন পাস হয়। তখন থেকে অস্থায়ীভাবে চলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।

চট্টগ্রামে স্থাপন হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫টি বিভাগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীর একাডেমিক সুবিধাসহ দেড় হাজার শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৯৬৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

চট্টগ্রামের চর রাঙামাটিয়ার হামিদচর এলাকায় প্রায় একশ’ একর জমিতে ‘গ্রিন ফিল্ড প্রজেক্ট’ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন হচ্ছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম পর্যায় এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

গত ২১ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সই করা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের আরএডিপি বরাদ্দের ৭১ দশমিক ৪০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। এ সময় আরএডিপি বাস্তবায়নের জাতীয় অগ্রগতি ছিল ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।

ওই সভায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘জুন ২০২৩ পর্যন্ত জাতীয় অগ্রগতির চেয়ে আমাদের অগ্রগতি অনেকটাই কম।’

কার্যবিবরণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ার জন্য কতিপয় সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ২৩টি প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক না থাকা। অনেক বড় বড় প্রকল্পে পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়।’

পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ না দিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই দায়িত্ব ধরে রেখেছেন। এতে প্রকল্প ধীর গতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। যেমন ‘রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের পিডি উপাচার্য নিজেই। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর অগ্রগতির জন্য পিডিরা কর্তৃক প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে তার ওপর অর্পিত আর্থিক ক্ষমতা প্রয়োগ না করা, করতে না পারাও অন্যতম কারণ।

বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের পিডিদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশ^বিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য উপাচার্য কর্তৃক একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটিতে পিডিরা সভাপতি হিসেবে থাকলেও উপাচার্যের অনুমোদন ব্যতিরেকে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের কোন ক্ষমতা পিডিদের থাকে না। প্রায় সব বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকল্পসমূহের অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে।’

ব্যয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় না করেই এডিপি/আরএডিপি প্রণয়ন করার কারণে কোন কোন প্রকল্পে ‘অকারণেই অব্যয়িত’ অর্থ রয়ে গেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এডিপি/আরএডিপি প্রণয়নকারণে প্রকল্পের প্রতিটি অংশের বাস্তব অবস্থা এবং ক্রয় পরিকল্পনা বিবেচনা করা হলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হত না।’

এছাড়া মাঠপর্যায়ের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা না করেই প্রকল্প প্রণয়ন/সংশোধন করায় প্রকল্প/সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব হয়ে থাকে-মন্তব্য করে কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্ধ ছাড়ে বিলম্ব এবং বাস্তবায়ন কাজ সময়মতো করা সম্ভব হয় না।

জানা গেছে, শিক্ষার মোট প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৩৩টির মেয়াদ গত জুনে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়নি। এ কারণে ৩৩টি প্রকল্পের মধ্যে ইতোমধ্যে ১২টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরও ১৯টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রকল্পের বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড় না করার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.012272119522095