যশোরের মনিরামপুরের এক বিদ্যালয়ে তিন কর্মচারী নিয়োগে সাড়ে ২৫ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে তিনি ১৫ লাখ টাকা নিজের হেফাজতে রাখার কথা স্বীকার করে গত বছর বিদ্যালয়ের প্যাডে পরিচালনা কমিটিকে লিখিত দেন। এখন এক বছরেও সেই টাকার কোনো হিসাব দিচ্ছেন না। এ ঘটনায় জেলা ও উপজেলা শিক্ষা দপ্তরসহ নানা দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কমিটির সদস্যরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে কাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিরাপত্তা কর্মী পদে শান্ত হোসেন, অফিস সহায়ক পদে আহসানুর রহমান ও ল্যাব সহকারী পদে ফাহিম আহমেদকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক আবু জাফর সিদ্দিকী ক্ষমতাশীল দলের অনুসারী হওয়ার সুযোগ খাটিয়ে কমিটির অন্য সদস্যদের বাদ রেখে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিজের পছন্দের তিনজনকে নিয়োগ দিয়েছেন।
পরে কমিটির সদস্যদের চাপের মুখে বিদ্যালয়ের সভায় প্রধান শিক্ষক সাড়ে আট লাখ টাকা করে নিয়োগ পাওয়া তিনজনের কাছ থেকে সাড়ে ২৫ লাখ টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
পরিচালনা পর্ষদের অভিভাবক সদস্য জাহাঙ্গীর মোড়ল বলেন, ‘সাড়ে ২৫ লাখ টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে প্রধান শিক্ষক নানা খাতে খরচ দেখানো শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি নিজের কাছে নিয়োগ বাণিজ্যের ১৫ লাখ টাকা গচ্ছিত থাকার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তিনি টাকা আমাদের সামনে হাজির করেননি। তখন আমরা কমিটির সদস্যরা বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ওই ১৫ লাখ টাকা খরচ করব মর্মে সিদ্ধান্ত নিই।’
জাহাঙ্গীর মোড়ল বলেন, ‘গেল বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ের প্যাডে এই বিষয়ে লিখিত হয়েছে। সেখানে প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষর করেছেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ের উন্নয়নের কাজে টাকা বের করার জন্য আমরা প্রধান শিক্ষককে চাপ দিতে থাকি। এই পর্যন্ত তিনি কোনো টাকা বের করেননি।’
জাহাঙ্গীর মোড়ল আরো বলেন, ‘এলাকাবাসী ধারণা করছেন নিয়োগ দিয়ে আমরা সদস্যরা টাকা খেয়ে ফেলেছি। আমাদের মেয়াদ প্রায় শেষ। কোনো টাকা না ছুঁয়ে আমরা এর দায় নেব কেন? এ জন্য প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আবু জাফর বলেন, ‘যে সাড়ে আট লাখ টাকা করে নেয়ার কথা উঠছে তা নিয়োগ বোর্ডসহ অদৃশ্য বিভিন্ন খাতে নিয়োগ পাওয়ারা নিজেরা খরচ করেছেন। আমি পাঁচ লাখ করে ১৫ লাখ টাকা হাতে পেয়েছি।’
টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসেব নম্বরে জমা না রাখার কারণ জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘অবৈধভাবে নেয়া এসব টাকা ব্যাংকে রাখলে বিপদ হতে পারে। এই ভয়ে নিজের কাছে রেখেছি। সেই টাকা থেকে বিদ্যালয়ে চেয়ার, বেঞ্চ, টেবিল তৈরি, কম্পিউটার প্রিন্টার ক্রয়ে খরচ করা হয়েছে। সামনে বিদ্যালয়ের কমিটির নির্বাচন। সেখানে ১৮-২০ হাজার টাকা খরচ আছে সেটাও এখান থেকে দিতে হবে।’
এসব কাজে কত টাকা খরচ হয়েছে তার হিসাব না জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সব খরচের ভাউচার আছে।’
এদিকে বর্তমান কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধিসহ কয়েকজন শিক্ষক জানান, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারিভাবে প্রতি শ্রেণির সব চেয়ার, বেঞ্চ ও টেবিল দেয়া হয়েছে। নতুন করে শিক্ষকদের জন্য ১৩টি চেয়ার, তিনটি টেবিল ও প্রধান শিক্ষকের চেয়ার টেবিল তৈরি করা হয়েছে। কম্পিউটারের প্রিন্টার নষ্ট ছিল সেটা মেরামত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক নিজের কাছে ১৫ লাখ টাকা থাকার যে হিসাব দিয়েছেন তার আগে এসব খরচ সম্পন্ন হয়েছে দাবি শিক্ষকদের।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি গোলাম ফারুক লিটন বলেন, ‘আমি যশোর শহরে থাকি। আবু জাফর বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাতে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। এ জন্য কর্মচারী নিয়োগের সব দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি যে নিয়োগ বাণিজ্য করে সব টাকা আত্মসাৎ করবেন সেটা ধারণা করিনি।’
সভাপতি আরো বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরাও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছি।’
এ বিষয়ে মনিরামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘কাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) একটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’