১.
তিনি লাল মিঞা কিংবা সুলতান, আমাদের পোশাকি ভাষায় এস এম সুলতান। বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চিত্রশিল্পী সুলতান ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামের এক অসচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেই হিসেবে মহান এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে এবার। জন্মশতবর্ষে ‘বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ শাশ্বত বাঙালি হ’–কে ধারণ করা অনন্য এই শিল্পীর অমর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। জীবিতকালে এই মহান চিত্রশিল্পীকে ঢাকায়, চারুকলায় একাধিকবার দেখবার, কথা বলারও সুযোগ হয়েছে। সেজন্য কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি চিন্তক মহাত্মা আহমদ ছফাকে। ছফা ভাইয়ের কারণেই চারুকলাসহ বিভিন্ন জায়গায় শিল্পী সুলতানের দেখা ও কথা শোনার, তার সঙ্গে কথা বলার বিরল সুযোগ ঘটে আমার। শিল্পী সুলতানের মৃত্যুর দুই দশক পর ২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে এসএম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা ও শিশুস্বর্গের বিভিন্ন কার্যক্রমও দেখে আসার সৌভাগ্য আমার হয়। সেই অভিজ্ঞতা লেখার সুযোগ আর হাতছাড়া করার লোভ সামলাতে পারিনি। সে সব কথাও থাকলো লেখায়।
২.
এসএম সুলতানকে নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক। বোধ করি বাংলাদেশের আর কোনো শিল্পীকে নিয়ে, তার জীবন ও কর্ম নিয়ে, এতো তোলপাড় করা ইতিবাচক ও নেতিবাচক তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। সুলতানের নির্লোভ স্বভাব, বোহেমিয়ান জীবন এ সবকিছুই একেবারে আলাদা সুশীল সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পবলয় থেকে। যে-শিল্পচর্চার আঙ্গিক গঠিত হয়েছিলো দুশো বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসন শুরুর মধ্য দিয়ে, সুলতান প্রত্যাখ্যান করেছেন এই ঔপনিবেশিক দাসত্ব। সুলতানকে অনেকে দেখেন প্রান্তিক শিল্পী হিসেবে, অনেকে তার শিল্পকর্মের গুণ বিচার করেন তাকে নেইভ (বন্য) বলে। আবার সুলতানের মৌলিকত্ব নিয়ে মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘তবু তাদের কোনো পূর্বসূরি নেই, নেই কোনো উত্তরসূরি। আচমকা জলতল থেকে সুবর্ণস্তম্ভের মতো উত্থিত হয়ে দণ্ডায়মান হয়ে রয়েছে।’ নানা মুনির নানা মত থাকবেই। মনে পড়ছে, ‘ক্যামেরার কবি’ নাসির আলী মামুনের সঙ্গে আলাপনে মনীষী আহমদ ছফা সুলতানকে ‘মহামানব’ হিসেব্যে আখ্যায়িত করে স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি, সেই তিনিই আবার লিখেছেন, ‘তিন দিনের বেশি একসঙ্গে থাকলে তাকে সহ্য করা যেতো না। মনে হতো তাকে খুন করি’।
৩.
স্বর্গে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে মোটেই ভাবিত নই আমি, কোনোকালেই ততোটা লোভীও ছিলাম না বটে, তবে অনেকদিন ধরেই যাবো যাবো করেও সুযোগ হয়ে ওঠেনি প্রিয় শিল্পী এস এম সুলতানের শিশুস্বর্গে নড়াইলে যাওয়া। যশোর সরকারি এমএম কলেজে মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষার বহির্পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে তাই আর মিস করিনি নড়াইল গিয়ে এস এম সুলতানের স্মৃতিসংগ্রহশালা ঘুরে দেখতে। ২০১৪-এর ৮ সেপ্টেম্বর যশোরের সুপ্রিয় স্বজন, শিক্ষক বন্ধু আশুতোষের সঙ্গে সাধ মিটিয়ে ঘুরতে গেলাম বহুকাঙ্ক্ষিত সুলতান রাজ্যে। সেখানে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় ‘এস এম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা’ বন্ধ দেখে নিরাশ না হয়েও দুবন্ধু শরণাপন্ন হলাম আমার আরেক প্রিয়জন মেহেদির বাল্য সহপাঠী-বন্ধু এবং নড়াইল সদরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আব্দুল সাদীর। আক্ষরিক অর্থেই তিনি কয়েক মুহূর্তেই আমাদের প্রিয়জন, বন্ধু হয়ে উঠলেন, ‘অতুলনীয়’ সমাদরে, পরমাত্মীয় জ্ঞানে সহযোগিতাও করলেন। তিনি নিজেও সঙ্গও দিলেন সারাক্ষণ। অমায়িক ভদ্রলোক এবং সদালাপী সাদী ভাইয়ের চমৎকার সুসঙ্গ ছিলো আমার জন্য ‘বোনাস’ উপহার। তার কারণেই ‘এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’ ঘুরে দেখার সুযোগ পেলাম, দায়িত্বশীল কর্মীদের কাছ থেকে নানা তথ্য-স্মৃতিও জানতে পারলাম।
৪.
পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বিশ্বের নামীদামি আঁকিয়ের চিত্রশিল্পগুলোর সঙ্গে প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশের অখ্যাত এক গ্রাম্য শিল্পীর ছবি। সেই সময় চিত্রশিল্প বাংলাদেশে এতোটা প্রভাব বিস্তার করেনি, শিল্পবোদ্ধাও আজকের মতো এতো ছিল না বলে আধুনিক সমাজে বিশ্ব জয় করা নড়াইলের এক তরুণ শিল্পীর কথাও কান এড়িয়ে যায় সকলের। একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার নাম ছড়িয়ে গেলেও নিজের দেশেই তিনি অনাবিষ্কৃত! কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর সেই শিল্পীর কথা আর অজানা থাকে না বাংলাদেশের মানুষের। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তাই রাজধানী ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয় বিশ্বজয়ী চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে। চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রথমবার নড়াইল থেকে ঢাকায় আসেন এস এম সুলতান, দেশের শিল্পসমাজে নতুন করে পরিচিতি পান তিনি। কী ছিলেন সুলতান? সুলতান আদ্যোপান্ত মানুষ ছিলেন। যে প্রচলিত জীবনের লোভ–লালসা ছেড়ে শিল্পের ভেতর দিয়ে কোথাও পৌঁছেছিলেন সুলতান। মানুষ যে শক্তিময়তার দিক থেকে অনেক বড় এ সত্যের পরিচয় মেলে সুলতানের সৃষ্টি করা ক্যানভাসে চোখ রাখলেই৷ তার ছবিতে কখনো কৃশকায় মানুষ দেখা যায় না, দেখা যায় পেশীবহুল স্বাস্থ্যবান অবয়ব৷ প্রগাঢ় সাহসী জীবনবোধের এক নিবিষ্ট চিত্রকর এস এম সুলতান। ‘আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলছি৷ আমার সকল চিন্তা, সবটুকু মেধা, সবটুকু শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করি তা কেবল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য, সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য৷ আমার ছবির মানুষেরা, এরা তো মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে স্ট্রাগল করেই এরা বেঁচে থাকে৷ এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম৷ শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি৷ আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার৷ ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম।
৫.
শিল্পীর বাসভবন, শিশুস্বর্গ ও সমাধিস্থল ঘিরে ‘এস এম সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা’ নির্মাণ করা হয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গণপূর্ত বিভাগ ২০০১-এর জুলাইয়ে সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৩ সালের জুনে কাজটি শেষ হয়। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয় সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। দেখভালের জন্য চুক্তিভিত্তিক ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রথমদিকেই তা বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে একজন সহকারী কিউরেটর ও মালি আছেন। লোকবলের অভাবে প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে আসা সুলতানভক্তরা সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা তালাবদ্ধ দেখে হতাশ মনে ফিরে যান। সংগ্রহশালায় রাখা সুলতানের ছবি ও ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র নষ্ট হতে চলেছে। তবে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা ও শিশুস্বর্গের কার্যক্রম। প্রতিদিন বহু মানুষ ঘুরতে আসেন সুলতানের বাড়িতে। কিন্ত তারা হতাশ হন। দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ থাকায় সুলতানের দুর্লভ চিত্রকর্মসহ তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুলতানপ্রেমী দর্শনার্থীরা সুলতানের দুর্লভ শিল্পকর্ম ও স্মৃতিগুলো পুরোপুরি দেখতে পারছেন না। ফলে সুলতানপ্রেমী দর্শকরা এখানে এসে শিল্পকর্ম ও স্মৃতিগুলো দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো নয়। থাকার কোন ভালো ব্যবস্থা নেই। সুলতান কমপ্লেক্স ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবিও রয়েছে উপেক্ষিত। শিল্পী সুলতান ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে শিশুদের জন্য একটি ইঞ্জিনচালিত দ্বিতলা ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ (নৌকা) নির্মাণ করিয়েছিলেন। এ নৌকায় চড়ে শিশুদের নিয়ে নিয়মিত বের হতেন এবং চিত্রা নদীর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ছবি আঁকা শেখাতেন সুলতান।
৬.
শিশু, বৃক্ষ, মানুষ, প্রকৃতি-সবকিছুর প্রতিই তার অফুরন্ত ভারোবাসা। চিরকুমার শিল্পী ছবি এঁকেছেন দুই হাতে। ব্যবহার করেছেন দেশজও লতাপাতা শেকড়ের নির্যাস থেকে সংগৃহীত রঙ। মোট ছবির সংখ্যা তিনি নিজেও জানতেন না। যা তিনি কখনো সংরক্ষণের তাগিদ অনুভব করেননি। যাকে খুশি তাকে দিয়েছেন অকাতরে। নড়াইলে তার শিশুস্বর্গ, যেখানে বাস করতেন, সেখানে বৃক্ষ এবং দুর্লভ ফুলে ভরা ছিলো। ছিলো বহু পাখি ও জীবজন্তু। তাদের নিজ হাতে তিনি সেবা করতেন। শুধু রঙতুলির স্পর্শের মধ্যে তিনি সৌন্দর্য অন্বেষণ করেননি, বাস্তবেও প্রমাণ দিয়েছেন ভালোবাসার। তাই ঢাকার ফুটপাথ থেকে দুর্লভ নাগলিঙ্গম বৃক্ষ নিধন হতে দেখে তার চোখ প্লাবিত হয়েছিলো।
৭.
নদীটির নাম চিত্রা। এটি নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে৷ মাছিমদিয়া গ্রামেই কয়েকটি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে ধাউড়িয়া বাড়ি। ধাওড়িয়া বাড়ির লোক মেছের নড়াইলের জমিদার বাড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। স্ত্রী, ছেলে লালমিয়া ও মেয়ে ফুলমণিকে নিয়ে তার চারজনের সংসার। অভাব অনটন লেগেই আছে এ সংসারে। অভাবের এই সংসারে লালমিয়া জন্মগ্রহণ করেন। মেছের ধাওড়িয়ার একার উপার্জনে চলে এই সংসার। কিন্তু লালমিয়া ও ফুলমণিকে রেখে মেছেরের স্ত্রী হঠাৎ মারা গেলে অভাবের সংসারে দেখা দেয় নতুন সংকট। ছেলেমেয়ে ও সংসারের কথা চিন্তা করে মেছের আবার বিয়ে করেন নড়াইল থানার দুর্গাপুর গ্রামের আয়াতুন্নেসাকে। পরিবারের আভাব-অনটন তখনো তাদের নিত্যসঙ্গী। কারণ রাজমিস্ত্রীর কাজ করে যা আয় করেন তার পরিমাণ খুব সামান্য৷
৮.
সুলতানের পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। তবে এসএম সুলতান নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। পরিবারের লোকজন শৈশবে তাকে লাল মিয়া বলে ডাকত। প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও তার পিতা ১৯২৮-এ তাকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। যদিও লালমিয়ার বাবার ইচ্ছে ছিলো তাকে ভালোভাবেই পড়াশোনা করাবেন, কিন্তু সামর্থ হয়নি তার৷ সংসারের অভাবের যন্ত্রণার সঙ্গে যোগ হয় লালমিয়ার উপর সৎ মায়ের অত্যাচার৷ এভাবেই চলছিলো লালমিয়ার পড়াশোনা। বাবার কাজে সহযোগিতা আর বাঁশি বাজানো। অদ্ভুত সুন্দর বাঁশি বাজাতেন লালমিয়া। তার এই বিশেষ গুণটির কথা স্কুলের সহপাঠীসহ এলাকার সব মানুষরা জানতেন৷ নড়াইলের জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাট, স্কুলের অনুষ্ঠান ছাড়াও বনবাদারে ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজাতেন তিনি। সে কারণে বংশীবাদক হিসেবে লালমিয়াকে অনেক মানুষ চিনতেন৷ এমন কথাও শোনা গেছে, জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটে লালমিয়া বাঁশি বাজানোর সময় কেউটে সাপ দুই পাশে নাচতো৷ ছবির প্রতিও ছিলো লালমিয়ার ভীষণ টান। কোনোকিছু ভালো লাগলেই ছবি আঁকতেন। আঁকতেন চকখড়ি, কাঠকয়লা, হলুদ আর পুঁই ফলের রস দিয়ে৷ ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর তার বাবার ইচ্ছাতেই লালমিয়া এ বি এস জুনিয়র মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় লালমিয়া সৎ মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে তিন আনা বারো পয়সা, একটি ছাতা, গুটিকয় জামা-কাপড় আর একটি ঠিকানা নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। বোন ফুলমণি মা হারা ভাইয়ের পিছু নেন। ‘ফিরে আয়, ফিরে আয়’ বলে কাঁদতে কাঁদতে ডেকে আকুল হন। লালমিয়া ফেরেননি।
৯.
এর আগে দশ বছর বয়সে স্কুল পরিদর্শনে আসা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ছবি এঁকে তার চোখে পড়েছিলেন। সুলতানের ইচ্ছা ছিলো সম্ভব হলে কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি সে ইচ্ছার পথে ছিলো বড় বাধা। এ সময় এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এস এম সুলতান ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা যান। কলকাতায় এসে তিনি ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতেই ওঠেন। ইচ্ছা ছিলো কোনো কাজ জোগাড় করে অর্থ উপার্জন এবং একই সঙ্গে শিল্প শিক্ষা। এ সময়ই তিনি প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। সুলতানের জন্য সোহরাওয়ার্দী তার গ্রন্থাগারের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং তাকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, যদিও ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সকল যোগ্যতা তার ছিলো না।
১০.
আর্ট স্কুলের বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার রীতিনীতি তার সহজাত বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছিলো। সুলতান ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তিনি ছিলেন ভবঘুরে বা ছন্নছাড়া। তিনি প্রকৃতিকে ভালবাসতেন একজন রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে এবং সেরকম তীব্রতা নিয়েই তিনি অস্বীকার করেছেন যান্ত্রিকতা-পিষ্ট নগর ও নাগরিক জীবনকে। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের পথে পথে। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ছোট বড় শহরগুলোতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি এঁকে ও তাদের কাছে ছবি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেছেন এবং প্রদর্শনীও করেছেন। শিল্পী হিসেবেও তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে ছিল পার্থিব বিষয়ের প্রতি অনীহা এবং কোনো এক স্থানে শিকড় ছড়িয়ে বসার প্রতি তীব্র অনাগ্রহ।
১১.
দেশ বিভাগের পর সুলতান কিছুদিনের জন্য দেশে ফেরেন। কিন্তু তারপরই ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলে শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুবছর কাজ করেন। এ সময়ে চুঘতাই ও শাকের আলীর মতো শিল্পীদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ইতোপূর্বে ১৯৫০-এ চিত্রশিল্পিদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য তিনি আমেরিকা যান এবং নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন এবং এরপর লন্ডনে তার ছবির প্রদর্শনী করেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আবার নড়াইল ফিরে তিনি শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। শিশুদের নিয়ে সুলতানের অনেক স্বপ্ন ছিলো। শেষ বয়সে নড়াইলে ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এর কিছু বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নড়াইলে তিনি ‘নন্দন কানন’ নামের একটি প্রাইমারি ও একটি হাইস্কুল এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
১২.
মধ্য পঞ্চাশে ঢাকায় যখন আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক কাজ হচ্ছে এবং প্রচুর উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে শিল্পীরা শৈলী নিয়ে, ফর্ম নিয়ে, মিডিয়া নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন তখন সকলের দৃষ্টির আড়ালে তিনি নড়াইলেই রয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন, কিন্তু তার জীবনের মূল সুরটি বাঁধা ছিলো গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের ছন্দের সঙ্গে। সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জীবনের প্রধান উৎসকেন্দ্রটি, বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব ও সংগ্রাম এবং নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস এবং অনুপ্রেরণা। তিনি কৃষক পুরুষের শরীরকে করেছেন পেশীবহুল এবং বলশালী, কৃষক রমণীর শরীরকে এঁকেছেন সুডৌল ও সুঠাম গড়নে, তাকে দিয়েছেন যুগপৎ লাবণ্য এবং শক্তি। সুলতানের ছবিতে পরিপূর্ণতা এবং প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি আছে শ্রেণির দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রুর বাস্তবতার চিত্রও। হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৭) ও চরদখল (১৯৮৮) এ রকম দুটি ছবি।
১৩.
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সুলতান শিল্পরসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যান। মধ্য সত্তরে তার কিছু শুভানুধ্যায়ী তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় থেকে তিনি কিছু ছবি আঁকেন এবং ১৯৭৬-এ সেসব ছবি দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বস্ত্তত, এ প্রদর্শনীটিই তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। এ ছবিগুলিই সুলতানকে নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতিনিধি এবং তাদের নন্দনচিন্তার একজন রূপকার হিসেবে উপস্থাপিত করল। তার ছবিতে গ্রাম হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র এবং কৃষকই হচ্ছে প্রকৃত জীবন শিল্পী। গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন তার সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। এজন্য কৃষক ও কৃষকের জীবন একটা কিংবদন্তীর শক্তি নিয়ে উপস্থিত তাঁর ছবিতে। তাঁর কাজে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তার আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি,দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে,উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং উপনিবেশিকোত্তর সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনা করেছেন।
১৪.
সুলতান আশির দশক থেকে নড়াইলে থেকে যেতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন। তার কাছে আশ্রয় নেয়া মানুষ, শিশু এবং জীবজন্তুর প্রতি তার ভালবাসার জন্য তার বাড়িটিকে এদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটি চিড়িয়াখানা ছিলো তার। শিশুদের জন্য একটি বিরাট নৌকাও বানিয়েছিলেন। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের আরেকটি প্রদর্শনী হয়। আশির দশকের শেষ দিকে তার স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে, ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার গ্যালারি টোন-এ তার শেষ প্রদর্শনীটি হয়। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা
