দৈনিকশিক্ষাডটকম ডেস্ক : বয়স হয়ে গিয়েছিল ৭৮। কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতায় ভুগছিলেন। হাসপাতালে ছিলেন। এই তো সপ্তাহখানেক আগেই তাঁর ভাই ওয়াল্টার জানিয়েছিলেন, ‘যদি আমি বলি যে তিনি ভালো আছেন, তাহলে মিথ্যা বলা হবে। আমি মিথ্যা বলতে পছন্দ করি না। তিনি ভালো নেই। শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হচ্ছে তো আবার খারাপের দিকে যাচ্ছে।’
আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা হলো না ‘কাইজার’-এর। জার্মান ফুটবলের সম্রাট, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার কিছুক্ষণ আগে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁর পরিবারের কাছ থেকে জেনে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডিপিএ দিয়েছে এ দুঃসংবাদ।
ইতিহাসের সেরা ফুটবলারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও তাঁর নাম থাকবেই। সেটা খেলার ধরনের কারণে যেমন, তেমনি তাঁর রেকর্ডের কারণেও। মিডফিল্ডে শুরু করলেও পরে সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হয়ে গিয়েছিলেন, তা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার শুনলে মনে হতে পারে – ডিফেন্ডার হয়ে খেলার ধরনে আর কী-ইবা দেখিয়েছেন! যা দেখিয়েছেন, তাতে ফুটবলে এক পজিশনই সত্তরের দশকে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। লিবেরো!
ত্রিশের দশকে অস্ট্রিয়ার কোচ কার্ল রাপ্পান প্রথম এই লিবেরো বা মুক্ত ডিফেন্ডারের ধারণা ফুটবলে এনেছিলেন বলে মানা হয়। ইতালিতে কিংবদন্তি হেলেনিও হেরেরার কাতানেচ্চিও দর্শনেও ছিল লিবেরো। তবে সব ছাপিয়েও লিবেরো বললে সত্তরের দশকে বায়ার্ন মিউনিখ বা জার্মানির জার্সিতে বেকেনবাওয়ারকেই মনে পড়বে। রক্ষণে থেকেও বল নিয়ে ওপরে উঠে কীভাবে আক্রমণ গড়ে দেয়া যায়, সেটা তাঁর মতো করে আর কে দেখাতে পেরেছেন!
এ তো গেল খেলার ধরন। আর কীর্তি? সেখানে বেকেনবাওয়ারের অর্জন তাঁর উপাধির সঙ্গে মানানসই – কাইজার, সম্রাট! দুবার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন, এমন ডিফেন্ডার ইতিহাসে একজনই – বেকেনবাওয়ার। ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ), বিশ্বকাপ ও বালন দ’র – তিনটিই পেয়েছেন, এমন ফুটবলার ইতিহাসে যে নয়জন আছেন, তাঁদের একজন বেকেনবাওয়ার।
কিন্তু বেকেনবাওয়ারকে শুধু খেলোয়াড় হিসেবে মনে রাখলে তো চলবে না। কোচ হিসেবেও তো তিনি সফল। কদিন আগেই অন্যলোকে পাড়ি জমানো ব্রাজিল কিংবদন্তি মারিও জাগালো আর ২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে শিরোপা জেতানো কোচ দিদিয়ের দেশঁর পাশাপাশি আর একজনই আছেন ইতিহাসে, যিনি খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন – বেকেনবাওয়ার।
বায়ার্নের জার্সিতে টানা তিন ইউরোপিয়ান কাপ, চারটি লিগ, মাঝে দুই দফায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কসমসে খেলার মাঝে জার্মানিরই হামবুর্গের হয়েও একবার লিগ জেতা – ক্লাব ফুটবলে বেকেনবাওয়ার চূড়ান্ত সফল।
জাতীয় দলে তো তাঁর অর্জন আরও ঈর্ষাজাগানিয়া। পশ্চিম জার্মানির হয়ে ১০৩ ম্যাচ খেলেছেন, এর মধ্যে ১৯৭৪ বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছেন, রানার্সআপ হয়েছেন ১৯৬৬-তে। ইউরো জিতেছেন ১৯৭২-এ, রানার্সআপ ১৯৭৬-এ। কোচ হিসেবে জার্মানিকে ১৯৯০ বিশ্বকাপ জেতানোর পাশাপাশি ক্লাব ফুটবলে মার্শেইকে লিগ আঁ জিতিয়েছেন একবার, আর তাঁর প্রিয় বায়ার্নকে একবার লিগ জেতানোর পাশাপাশি একবার উয়েফা কাপ (বর্তমান ইউরোপা লিগ) জিতিয়েছেন।
সংগঠক হিসেবেও তাঁর সাফল্য কী কোনো অংশে কম! জার্মানিকে ২০০৬ বিশ্বকাপের আয়োজক করার পেছনে তাঁর অবদান যে কেউ স্বীকার করবেন, সে বিশ্বকাপের অর্গানাইজিং কমিটির প্রধানও তিনিই ছিলেন। সংগঠক হিসেবে অবশ্য কিছু বিতর্কেও জড়িয়েছে তাঁর নাম, জার্মানির ২০০৬ বিশ্বকাপ আয়োজন কিংবা ২০১৮ বিশ্বকাপ রাশিয়াকে ও ২০২২ বিশ্বকাপ কাতারকে দেওয়ার পেছনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফিফা এ নিয়ে তদন্তও করেছিল, সে তদন্তে সাহায্য করতে অস্বীকার করায় ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বেকেনবাওয়ারকে ৯০ দিন সব ফুটবল সংশ্লিষ্ট কাজে নিষিদ্ধও করে ফিফা। রাশিয়ার কাছ থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
তবে সে সব বিতর্ক এক পাশে রেখে বেকেনবাওয়ার মানে জার্মানিতে একটাই অর্থ – কাইজার। সম্রাট। ফুটবল ইতিহাসেও তো তা-ই।