বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের রকেটকে মাধ্যমিকের ১৬ লাখ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা বিতরণের দায়িত্ব দেয়ার চেষ্টা করছে শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি অসাধু সিন্ডিকেট। স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা বিতরণে ডাচ-বাংলার চরম ব্যর্থতার ইতিহাসও ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে এই সিন্ডিকেট। একাধিক সূত্র দৈনিকশিক্ষাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ডাচ-বাংলার রকেটকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হলে শুধু প্রতিযোগীতামূলক ফি নির্ধারণ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তকেই উপেক্ষা করা হবে না, ১৬ লাখ শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে প্রতি হাজারে ৯ টাকা করে চার্জ দিতে হবে। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক দেয়া উপবৃত্তির পুরো টাকাই ভোগ করতে পারবে না শিক্ষার্থীরা। টাকা তুলতে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রীদের ঘুরতে হবে ডাচ-বাংলার এটিএম বুথে অথবা এজেন্টের কাছে, দিতে হবে সার্ভিস চার্জ। আর সবাই জানে রকেটের এজেন্ট আর ডাচ-বাংলার অধিকাংশ এটিএম বুথে টাকা না থাকার বিরম্বনার কথা। উপবৃত্তির টাকা বিতরণের একই কাজ শিওরক্যাশকে দিলেও প্রতি এক হাজার টাকায় ৯ টাকা করে এজেন্টদের চার্জ দিতে হবে আর সার্ভিস চার্জ ০.৪৯ শতাংশ।
পক্ষান্তরে, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার বিকাশকে যদি উপবৃত্তির এই টাকা বিতরণের কাজটি দেয়া হয় তবে শিক্ষার্থীকে কোনো চার্জ দিতে হবে না। অর্থাৎ সরকার যদি কোনো শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি বাবদ মাসে এক হাজার টাকা দেয় তার পুরো টাকাটাই হবে ওই শিক্ষার্থীর, এক পয়সাও সার্ভিস চার্জ দিতে হবে না বা এটিএম বুথে দৌড়াতে হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত: ১০ই অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর এস কে সুর চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরসমূহের আওতায় পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা যেতে পারে। এতদ্ব্যতীত অনলাইন ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবাবহির্ভূত এলাকায় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এর মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ হ্রাসের জন্য প্রতিযোগীতামূলক ফি নির্ধারণের জন্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রদানকারী ব্যাংক/মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে।’ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন মাধ্যমিক শিক্ষা উপবৃত্তি, ২য় পর্যায় প্রকল্পের পরিচালক শরীফ মোর্তজা মামুন ও শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
প্রতিযোগীতামূলক ফি নির্ধারণ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত পাশ কাটানোর চেষ্টা: উপবৃত্তি প্রকল্প কর্মকর্তারা [নীচের ছবিতে দেখুন] এই ছকটি তৈরি করে ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থাপন করেন। শিওরক্যাশ, রকেট ও বিকাশের দেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে তৈরি করা ছকে দেখা যায় বিকাশের কোনো সার্ভিস চার্জ নেই, এজেন্ট চার্জও নেই। পক্ষান্তরে, ডাচ-বাংলার রকেটে সার্ভিস চার্জ না থাকলেও এজেন্ট চার্জ ০.৯০ শতাংশ। আবার শিওরক্যাশের সার্ভিস চার্জ ০.৪৯শতাংশ এবং এজেন্ট চার্জ ০.৯০ শতাংশ। সভায় উপস্থাপন করা তথ্যে বলা হয়, ‘ডাচ-বাংলার রকেট, রুপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশ।’ কিন্তু ব্রাক ব্যাংকের বিকাশ হলেও সেই তথ্য চেপে যাওয়া হয়। বলা হয়, ‘বিকাশের সঙ্গে চুক্তি করা সমীচীন হবে না। যে সকল ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং রয়েছে কেবল তাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা যেতে পারে।’ জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের জুলাই মাসের একটি পরিপত্রের বরাতে এমন ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে সভায়। সভায় উপেক্ষা করা হয়েছে গত ১০ অক্টোবর ডেপুটি গভর্ণর এস কে সুর চৌধুরী স্বাক্ষরিত সিদ্ধান্ত।
জানা যায়, প্রতিযোগীতামূলক ফি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত না অনুসরণ করে ডাচ-বাংলাকে কাজ দেয়া হলে বিষয়টি আদালতেও গড়াতে পারে। ঝুলে যেতে পারে উপবৃত্তি বিতরণের কাজ। সময়মতো উপবৃত্তির টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে ১৬ লাখ শিক্ষার্থী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০২ খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষায় উপবৃত্তি প্রকল্পে বিএনপি-জামাত-শাসনামলে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া এই চক্রের সদস্যরা ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষা অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সিদ্ধান্তের ভুল ব্যাখ্যা হাজির করানোর নেপথ্যে কাজ করেছেন। শিক্ষার্থীদের করা ডাচ-বাংলায় ৩৫ লাখের বেশি অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য চেপে যাওয়া হয়েছে।
অধিদপ্তরের পরিচালক (ফিন্যান্স এন্ড প্রকিউরমেন্ট) প্রফেসর মোজাম্মেল হোসেন চৌধুরী দৈনিকশিক্ষাকে বলেন, সবাই জানে ব্রাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ-বাংলার রকেট এবং রুপালীর শিওর ক্যাশ। তাছাড়া উপবৃত্তি বিতরণ সংক্রান্ত বাংলাদেশে ব্যাংকের ১০ অক্টোবরের সিদ্ধান্তে স্পষ্ট বলা হয়, ব্যাংক অথবা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার।
তিনি বলেন, ২৪ ডিসেম্বরের সভায় উপস্থিত অনেকেই হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০ অক্টোবরের সিদ্ধান্তের কথা হয়তো সবাই জানতেন না। বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করেই উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হবে। এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্প পরিচালক কাগজপত্র তৈরি করছেন।
জানা যায়, ২৪ ডিসেম্বরের সভায় হাজির করা তথ্য-উপাত্ত তৈরি করেছে উপবৃত্তি প্রকল্পে কর্মরত বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক। কীসের আশায় সরকারি কলেজের শিক্ষকতা ফেলে যুগ যুগ যাবত এই প্রকল্পে থাকেন তারা? এমন প্রশ্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও।
স্নাতক পর্যায়ে উপবৃত্তি বিতরণে ডাচ-বাংলার অনিয়ম: এ প্রসঙ্গে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিশিক্ষাকে জানান, এক হাজার ১৮১টি ডিগ্রি কলেজ ও ১ হাজার ৫৪টি ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে উপবৃত্তি বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীপ্রতি বছরে ৪ হাজার ৯০০ টাকা হারে ১২৩ জন শিক্ষার্থীর ৩ বছরের ১৮ লাখ ৮ হাজার ১০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাদের হাতে পৌঁছায়নি। রংপুরের কাউনিয়া ডিগ্রি কলেজ, লালমনিরহাট সরকারি কলেজ, লালমনিরহাট নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা, লালমনিরহাট আদর্শ ডিগ্রি কলেজ সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার প্রতিষ্ঠানের ৫৮ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হলেও তাদেরকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়নি। বৃত্তির অর্থ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে নানা টালবাহানা করে কালক্ষেপণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত বৃত্তির কোনো টাকা দেয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
স্নাতক (পাস) ও সমমানের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করতে সরকার উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে। স্নাতক উপবৃত্তি প্রকল্প শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনেও এসব দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উপবৃত্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হলেও অসংখ্য শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা পাননি। কেউ কেউ প্রথম কিস্তির টাকা পেলেও পরের কিস্তিগুলো পায়নি। আইএমইডির কর্মকর্তারা রংপুর, লালমনিরহাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে উপবৃত্তির অর্থ লোপাটের সত্যতা পান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপবৃত্তির টাকা বিতরণে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চরম অসহযোগিতা ছিল। টাকা বিতরণে শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠানপ্রধান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। উপজেলা বা কলেজভিত্তিক বিতরণকৃত টাকা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যার তথ্য দিতে পারেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। উপবৃত্তি পাওয়ার শর্ত ভঙ্গ অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির হার কম, ড্রপ আউট, বিয়ে হলে তাদের বাদ দিয়ে নতুন শিক্ষার্থী ঠিক করার বিষয়টি ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ।