মিয়ানমার থেকে সহিংস হামলার শিকার হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে হতাশার মধ্যে বসবাস করছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনদের বর্বরতা ও নির্মমতা তারা প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের মনে সেই আতঙ্ক, ভয়াবহতা, নৃশংসতা ও নির্যাতনের স্মৃতি জীবন্ত। তাদের অনেকেই এখন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন, এখন তাদের আয় করার সময় অথচ তারা ক্যাম্পের ভেতরে এমন জীবন কাটাচ্ছেন যেখানে কাজের সুযোগ সীমিত। অভাব, বেকারত্ব ও হতাশা তাদের মধ্যে অনেককে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে, ফলশ্রুতিতে তারা নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়াতে তাদের মধ্যে হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে এর ফলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষম সদস্যদের বেশিরভাগ বেকার, ক্যাম্পের মধ্যে তাদের জন্য কোনো কাজ নেই। আয়ের জন্য তাদের মধ্যে ইয়াবার চালান আনার প্রবণতা রয়েছে। এই কাজে ঝুঁকি থাকলেও প্রচুর টাকা আয় করা যায়। নানা কারণে রোহিঙ্গাদের হাতে এখন প্রচুর অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। অবাধে মাদকের ব্যবসা করে অনেক রোহিঙ্গা প্রচুর টাকার আয় করছেন। মাদক ব্যবসার আধিপত্য ধরে রাখার জন্য অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। তারা খুন, অপহরণ, মুক্তিপন আদায়সহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে গেছেন। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও শক্তি প্রদর্শনের জন্য রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে তারা গোলাগুলি, খুন, চাঁদাবাজি, মাদক পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা অংশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না। ক্যাম্পগুলোতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধী। তাদের নেতারা ক্যাম্পের মধ্যে বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াতে তারা এখন মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা সংগঠনগুলোর সঙ্গে এদের বিরোধ চলমান। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের অধিকারের কথা বলতে না পারে সেজন্য সুযোগ পেলেই তাদের নেতাদেরকে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। অনেকের মতে প্রত্যাবাসন বিরোধীরা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফেরার বদলে বাংলাদেশে রাখতে চাচ্ছেন। মিয়ানমারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে রাখতে চায়। রাখাইনের পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে এবং প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে তারা নানা ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে তৎপর থাকে। বাংলাদেশের ভেতরে এ ধরনের সশস্ত্র সংগঠনের অপতৎপরতা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিতে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে অসামাজিক ও বেআইনি কার্যকলাপে যুক্ত করে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে একটি গ্রুপ তৎপর রয়েছে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তথ্য রয়েছে। ক্যাম্পের পরিস্থিতি অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা সরবরাহ করছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এসব সংঘাত ও খুনোখুনির ঘটনাগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বোঝাতে চায় যে রোহিঙ্গারা উগ্র প্রকৃতির ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। এসব সন্ত্রাসী দলগুলোর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদেরকে সন্ত্রাসী প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে চায় বলে অনেকে মনে করে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ করার মতো নেতার অভাব রয়েছে। নতুন নেতৃত্ব যেন সংঘটিত না হতে পারে সেজন্য তাদেরকে হত্যার জন্য টার্গেট করা হচ্ছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গা নেতৃত্বের মধ্যে ফাটল সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা চায় না রোহিঙ্গারা সংঘবদ্ধ হোক, কারণ এতে প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ তৈরি হবে ও রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে। ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা রোহিঙ্গা নেতারা সন্ত্রাসীদের মুল লক্ষ্য এবং তাদেরকে তারা পরিকল্পিতভাবে সুযোগ পেলেই হত্যা করছে। প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করা ও প্রত্যাবাসন সমর্থন করা ক্যাম্পের মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবকদেরকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হত্যার জন্য টার্গেট করে। ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, ক্যাম্পের দোকানপাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবকদের নিয়ে আশ্রয়শিবিরে রাত্রিকালীন পাহারার ব্যবস্থা করা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অবস্থান, তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সহযোগিতা করলে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা, চাঁদাবাজি, মাদক ও সোনা চোরাচালানে যুক্তসহ অপহরণ, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা বেশ কিছু সংগঠন কার্যকর রয়েছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কারণে ক্যাম্পে বসবাসকারী সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কের মধ্যে থাকে।
ক্যাম্পে বসবাসকারী এই বিশাল জনগোষ্ঠীর তরুণরা বৈধভাবে কোনো কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এবং সীমান্ত দিয়ে অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্যের পথে পা বাড়ায়। ঝুঁকি নিয়ে মাদক পাচার করে অনেক টাকা আয় করছে দেখে অন্যরাও সে কাজে আগ্রহী হয়। অনেকে এ ধরনের কাজ থেকে টাকা জমিয়ে অবৈধ ভাবে বিদেশ পাড়ি দেয়। বাংলাদেশ ও আরাকানের মধ্যেকার পথগুলো সম্বন্ধে ভাল ধারণা থাকায় অসৎ ব্যবসায়ীরা তাদেরকে চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করে। মাদক ও চোরাকারবারিদের অনেকে মাদক, ইয়াবা ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। যতোই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ততোই বাড়ছে।
ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যেই দ্বন্দ্ব সংঘাত চলে। বর্তমানে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা, আরএসও ও নবী হোসেন গ্রুপ বেশি তৎপর। ক্যাম্প কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণই তাদের মূল টার্গেট। ক্যাম্পে এই তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কারণে প্রতিনিয়ত খুনোখুনি বাড়ছে। কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণসহ ২৫ কারণে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নিজেদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। প্রধান কয়েকটা কারণ হিসেবে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, আর্থিক লেনদেন, প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার উসকানি, মানসিক অস্থিরতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব, বেকারত্ব, মাদক ব্যবসা, মানব পাচার ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, জঙ্গি সংগঠনের কর্তৃত্ব নিয়ে টার্গেট কিলিং, বাদী হয়ে মামলা দায়ের, মামলার সাক্ষী হওয়া ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সহায়তা করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ইয়াবা ও আইসের কারবার নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে আশ্রয়শিবিরে সশস্ত্রগোষ্ঠী মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলি, খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটছে। আধিপত্য বিস্তারই এসব ঘটনার মুল লক্ষ্য। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৮০০ আখড়ায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচায় জড়িত রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা। মাদক চোরাচালান ঘিরে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী তৎপর। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে অস্ত্র, মাদক সরবরাহ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সক্রিয় রাখছে। মাদকের চালান রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আসার কারণে ক্যাম্পগুলো মাদক পাচারের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দল, সংঘর্ষ, গোলাগুলি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র ঘটনায় অনেক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন।
ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত, অপহরণ, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, সোনা চোরাচালানসহ ১৭ ধরনের অপরাধের অভিযোগে ২ হাজার ৩০৯টি মামলা হয়েছে এবং এতে ৫ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। সন্ধ্যার পর ক্যাম্পগুলো অপরাধের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে এবং এসব তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনির ঘটনা ঘটছে।
দাতা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দেয়াতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, উদ্বেগ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বরাদ্দ কমায় ক্যাম্পে দিন দিন আর্থসামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। অর্থের জোগান দিতে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। অর্থ বরাদ্দ কমানোকে বড় ধরনের বিপর্যয় বলেছেন বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডম স্কালপেল্লি। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে রোহিঙ্গারা মানবিক সহায়তার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। খাদ্য সহায়তা কমে যাওয়াতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পরিবারগুলো বিপজ্জনক পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের মতে, রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে অপরাধ বেড়ে যাবে। রোহিঙ্গারা সহিংসতার দেখে ও নৃশংসতার শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে এবং ক্যাম্পের সীমিত পরিসরে জীবন-যাপনের বাধ্য হচ্ছে, নিজ দেশে ফেরার কোনো নিশ্চয়তাও তারা পাচ্ছেন না। হতাশা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আশাহত বর্তমান তাদেরকে হত্যা, সহিংসতা, মাদক পাচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দিকে ঠেলে দিয়ে রোহিঙ্গা কাম্পগুলোকে অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ করে তুলছে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক