যশোর শহরের বেজপাড়া আজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে। মাত্র ১১ শতক জমির ওপর প্রথমে টিনশেডের ঘরে শুরু করা হয় পাঠ কার্যক্রম। এরপর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এলজিইডির অর্থায়নে দ্বিতল ভবন করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে মাত্র তিনটি ক্লাসরুম। দুই শিফটে ক্লাস করে ১৯০ জন শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক রয়েছেন ছয়জন। বিদ্যালয়টিতে নেই খেলার মাঠ। যে কারণে ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের কেউ খেলাধুলা করতে পারে না।
বিদ্যালয়টির অভিভাবক আবদুল হালিম বলেন, ‘আজিমাবাদ স্কুলে জমিস্বল্পতার কারণে নেই খেলার মাঠ। রয়েছে ক্লাসরুমের সংকট। ফলে আমাদের সন্তানরা খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’ বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আকলিমা আক্তার জানান, বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন হয়তো জমি পাওয়া যায়নি। মাত্র ১১ শতক জমিতে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভবনের পাশে যে সামান্য জমি রয়েছে সেখানে কিছু শিক্ষার্থী খেলাধুলা করে। তবে সেটা অপর্যাপ্ত।
ঝিকরগাছা উপজেলার নওয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে। ২৩ শতক জমির ওপর স্থাপন করা হয় বিদ্যালয়টি। ১৬১ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন ছয়জন শিক্ষক। এ বিদ্যালয়েও নেই খেলার মাঠ। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘জমি না থাকার কারণে আমাদের এখানে খেলার মাঠ নেই। তবে যতটুকু খালি জায়গা রয়েছে সেখানে স্লিপার ও দোলনা বসিয়ে শিক্ষার্থীদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। আর পাশে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্বল্প পরিসরে খেলার মাঠ আছে সেখানে আমাদের শিক্ষার্থীরা খেলতে যায়।’ তিনি বলেন, ‘খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকলে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।’
শুধু ওই দুটি বিদ্যালয় নয়, যশোরে খেলার মাঠ নেই ২২৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ২৯০। এর মধ্যে স্বল্প পরিসরে মাঠ রয়েছে ২৪৮টি বিদ্যালয়ে। সবচেয়ে খেলার মাঠ কম শার্শা উপজেলায়। এ উপজেলায় ৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই খেলার মাঠ। এছাড়া সদর উপজেলায় ৪৫টি, চৌগাছায় আটটি, অভয়নগরে ১৪টি, মণিরামপুরে ৪৪টি, বাঘারপাড়ায় ৩৩টি, ঝিকরগাছায় নয়টি ও কেশবপুরে ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই।
শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকা গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলা ছাড়াও সমাবেশ আয়োজন ও শ্রেণীকক্ষের বাইরে পাঠদানের জন্য প্রয়োজন হয় মাঠের। যদিও দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাড়ে ১০ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কোনো খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে যশোরে রয়েছে ২২৬টি বিদ্যালয়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, খেলার মাঠ ছাড়া একটি বিদ্যালয় কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। তাই খেলার মাঠ ছাড়া কোনো বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন নয়। আর যেসব অনুমোদিত বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় খেলার মাঠ স্থাপন করা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষের তুলনায় বাইরের শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়। খেলতে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সামাজিকীকরণ হয়। তাই বিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন অবশ্যই মাঠের বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। বর্তমানে যেসব বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, সরকারের উচিত সেখানে নতুন মাঠের ব্যবস্থা করা। কারণ খেলার মাঠ ছাড়া একটি বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ হয় না। আবার শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটবে না। আর মেধার বিকাশ না ঘটলে ওই শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে না।’
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহসান হাবীব বলেন, ‘লেখাপড়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো খেলাধুলা। যে বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই, ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটবে না যদি কর্তৃপক্ষ বিকল্প উপায়ে খেলাধুলা না করায়। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবশ্যই খেলার মাঠ থাকতে হবে।’
যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলেন, ‘জেলায় ১ হাজার ২৯০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে নতুন ভবন সম্প্রসারণ, স্থানান্তরসহ নানা কারণে জমিস্বল্পতায় ২২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে খেলার মাঠ নেই। এসব বিদ্যালয়ে মাঠ করার সুযোগও নেই। এরই মধ্যে যেসব স্কুলে খেলার মাঠ নেই, আমরা সেসব স্কুলের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার নানা দিক নিয়ে প্রতি বছর ‘অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেন্সাস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা, শ্রেণীকক্ষ, স্যানিটেশন, খেলার মাঠসহ বিভিন্ন সেবা ও সুযোগ-সুবিধার তথ্যাদি তুলে ধরা হয়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। এর মধ্যে খেলার মাঠ রয়েছে ৫৪ হাজার ৮২৬টিতে। সে হিসাবে দেশের ১০ হাজার ৭৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই।