খোলা আকাশের নিচে ক্লাস। পাশে কৃত্রিম ঝর্ণা থেকে বেয়ে পড়া ঝিরিঝিরি পানির শব্দ। এ যেন প্রকৃতির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার এক উপযুক্ত আয়োজন। গত রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) দর্শন বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের এমনই অভিনব ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ক্লাসের বিষয় ভারতীয় দর্শন থাকলেও পুরো ক্লাসটি ছিলো জীবন নিয়ে। একজন শিক্ষার্থী কীভাবে জীবন পার করবে, কীভাবে জীবনের কঠিন সময় পার করবে এ নিয়ে ছিলো নানান দিক নির্দেশনা। ছিলো বিখ্যাত মানুষদের নানান উক্তি, ছিলো সফল মানুষের জীবন জয়ের খণ্ড গল্পও।
এমন জীবন জয়ের ক্লাস ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নিয়ে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. রেবেকা সুলতানা। শুরুতে এমন ক্লাস নিতে নানা বাধার মুখে পড়তে হলে, পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে সেমিস্টারের শেষ ক্লাসটি উন্মুক্ত স্থানে নেন তিনি। এ পর্যন্ত ৮টির বেশি এমন ক্লাস নিয়েছেন এ অধ্যাপক।
অধ্যাপক ড. রেবেকা সুলতানা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে গবেষণার কাজে বিশ্বভারতী থেকে দেশে ফিরলে শিক্ষার্থীরা সেখানকার অভিজ্ঞতা জানতে চায়। আমি দেখেছি, বিশ্ব ভারতীতে বা শান্তিনিকেতনে বেশিরভাগ ক্লাসই গাছ তলার হয়। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করার পর, তারাও এমন ক্লাস করার আবেদন জানায়। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ক্লাসটি এখন পর্যন্ত নিয়মিত হয়ে আসছে।
তিনি বলেন, এ ক্লাসে মূলত সিলেবাস থেকে বেরিয়ে, জীবন, জগৎ, ক্যারিয়ার, সেই সঙ্গে অতীত যে তার মূল জায়গা না এবং বর্তমান যে মূল জায়গা সেটি ধরিয়ে দিয়ে স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করি। কারণ স্বপ্ন এমন একটা বিষয়, যা একজন মানুষকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
বৃটিশ দার্শনিক জেমস অ্যালেনের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক রেবেকা সুলতানা বলেন, পৃথিবীর রক্ষা কবজ হল স্বপ্ন। মানুষ যেদিন আর স্বপ্ন দেখবে না, সেইদিন ভাল কিছু আর সৃষ্টি হবে না। কারণ স্বপ্নের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে বাস্তবতা আর জীবনের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যু। তাছাড়া বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে টিকে থেকে বিশ্বকে সে কিভাবে নেতৃত্ব দেবে সেই স্বপ্ন দেখতেও শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করা হয়।
কেনো জীবনভিত্তিক ক্লাস নেয়া হয় জানতে চাইলে অধ্যাপক রেবেকা সুলতানা জানান, আমাদের শিক্ষার্থীরা কেউ দীর্ঘ সময় হতাশায় ভোগেন। কেউবা শেষমেশ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। জীবনের এ চলার পথে একজন শিক্ষার্থী যদি কারো সহযোগিতা নাও পায়, সে যেন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে পারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাছাড়া এদিনের লেকচারটি পুরো সিলেবাসের মধ্য রেখে কোন বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিলে পরীক্ষায় ভালো করবে সেই বিষয়গুলোও আলোচনাতে রাখা হয়।
এমন ব্যতিক্রমধর্মী ক্লাস তার সহকর্মীরা কীভাবে নেন জানতে চাইলে অধ্যাপক রেবেকা সুলতানা আরও বলেন, প্রথম দিকে অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে দেখতেন না। তবে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনেকেই ইতিবাচকভাবে নেয়া শুরু করেছেন।
এদিকে ইট-পাথর আর চেয়ার-টেবিলের ক্লাসরুমের বাইরে এসে এমন পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণে উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা। এমন ক্লাস করতে পেরে শিক্ষার্থীর চোখে-মুখেও যেন তৃপ্তির ছাপ। ব্যতিক্রমধর্মী এ ক্লাস যেন তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এক নতুন সংযোজন।
জাহিদ হাসান নামে এক শিক্ষার্থী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এমন ক্লাস সত্যিই অনেক উপভোগ্য ছিলো। প্রচলিত ক্লাসের বাইরে উন্মুক্ত পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে ক্লাস অনেক ভাল লেগেছে। সপ্তাহ কিংবা মাসে যদি এমন ক্লাসের আয়োজন থাকলে অনেক ভালো লাগতো।
ফারাহনাজ ঐশি নামে আরেক শিক্ষার্থী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, প্রাকৃতির সান্নিধ্যে এসে ভারতীয় দর্শনের ক্লাস আমাদের কাছে এক অন্য রকম প্রাপ্তি। ম্যামের কাছে অনুরোধ, এমন ক্লাসের সংখ্যা যেন ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি করা হয়।
উন্মুক্ত খোলা আকাশের নিচে এমন ক্লাস সিনেমাতে দেখা পাঠশালার সঙ্গে অনেকটাই মিল পেয়েছেন রিয়াদ হাসান নামে আরেক শিক্ষার্থী। তিনি দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, প্রচলিত বদ্ধ ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এমন ক্লাস ছিলো প্রাণবন্ত। অনেকটা সিনেমাটিক। তাছাড়া প্রচলিত ক্লাসের তুলনায় বেশ ভালো মনোনিবেশ করতে পেরেছি।
খোলা মাঠে অভিনব ক্লাস অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সম্পুর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা যোগ হয়েছে বলে মনে করেন বিভাগটির আরেক শিক্ষার্থী ফাইজা ইসলান দিসা। দিসা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে সম্পূর্ণ এক নতুন পরিবেশেও যে জ্ঞান চর্চা করা সম্ভব। তা আমার জীবনে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সুমন আহম্মেদ নামে আরেক শিক্ষার্থী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, জীবনে সমস্যা এলে তা কীভাবে মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, নিজেকে কীভাবে সফল ও উদাহরণ সৃষ্টির মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় এমন নানান দিক নির্দেশনা পেয়েছি।