বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত দূরশিক্ষণনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণমানুষের শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিলো বাউবি। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং ৮০টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র নিয়ে প্রায় ১ হাজার ৫৪৫টি স্টাডি সেন্টারের মাধ্যমে ৬৮টি একাডেমিক প্রোগ্রাম চালিয়ে আসছে বাউবি।
বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আমলের গণনিয়োগ এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড নানা দিক থেকে সুনাম ক্ষুণ্ন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাদের গৃহীত নানা হঠকারি সিদ্ধান্ত ধীরে-ধীরে এক অন্ধকূপের দিকে ঠেলে দেয় বাউবির ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫১৩ শিক্ষার্থীর জীবনকে। এমনকি বাউবির সর্ববৃহৎ স্কুল হিসেবে পরিচিত এসএসএইচ এলের ডিনের নেতৃত্বে আইন বিভাগের সনদ বিক্রি ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সনদ বিক্রির এই ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ প্রচার হওয়ার পর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে ফ্যাসিবাদী প্রশাসন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সনদ জালিয়াতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এসএসএইচ এলের ডিনকে সভাপতি করে তৈরি করা হয় হাস্যকর এক তদন্ত কমিটি। লজ্জার বিষয় তারা সনদ জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার থেকে অপরাধীদের রক্ষা করার কাজেই বেশি তৎপর ছিলো না।
সম্প্রতি জুলাই বিপ্লব শুরু হলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেখানে নৈতিক দাবি দাওয়ার পক্ষে ছিলেন। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অন্তত আন্দোলনকারীদের পাশে থেকে তাদের নৈতিক দাবিকে সমর্থন জুগিয়েছেন সেখানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চলেছে পুরোপুরি উল্টো পথে। তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলো।
বাউবির অনির্বাচিত শিক্ষক সমিতি সিংহভাগ শিক্ষকের মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজের মতো করে প্রথমে বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা পরে আরেকটি মানববন্ধনও করেছে। ধিকৃত সেই মানববন্ধনে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের পাশাপাশি সনদ জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত ডিন ছিলেন মধ্যমণি। পাশাপাশি অনির্বাচত শিক্ষক সতিমির প্রতিটি সদস্যের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের ডিন ও বিভাগের ডিরেক্টররা উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রদবদল হলেও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এখন স্থবির হয়ে আছে গণহত্যায় সরাসরি মদদ দেয়া শিক্ষক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায়। গণহত্যার পক্ষে থাকার দায় নিয়ে বাউবির প্রোভিসি প্রশাসন বিদায় নিলেও উপাচার্যসহ অন্য আরেকজন প্রোভিসি (শিক্ষা), ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার এবং প্রতিটি স্কুলের ডিনসহ ফ্যাসিবাদী আমলের ডিরেক্টররা স্বপদে বহাল।
গণহত্যায় মদদ দেয়া, প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাউবিকে অস্থিতিশীল করে রাখার পাশাপাশি আর্থিক কেলেঙ্কারিনির্ভর গণনিয়োগ ও গণবদলিতে অতিষ্ট এখানকার প্রতিটি অংশীজন। বিগত দুই উপাচার্যসহ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা প্রায় সবাই নিজ আত্মীয়দের এখানে চাকরি দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক উপাচার্য এম এ মান্নান তার সন্তানের যোগ্যতা না থাকায় বারংবার নীতিমালা পরিবর্তন করে নিজ সন্তানকে সরাসরি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি তার কোমর ব্যথায় থেরাপি দিতে আসা থেরাপিস্ট এবং তার স্ত্রীকেও অন্যায়ভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো অধ্যাপক মান্নানের সময়ে।
গণনিয়োগ ও গণবদলির পাশাপাশি আর এটা নিয়ে যেসব শিক্ষক বিরোধিতা করেছিলেন তিনি তাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে তাদের পদন্নোতি ও পদবঞ্চিত করেছেন, যোগ করেন তিনি।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে আসার পর সৈয়দ হুমায়ূন আখতার তার প্রথম টার্ম শেষ করেন নানাবিধ দিবস উদযাপন এবং অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া থেকে নানা দিবস উদযাপনে সব ধরনের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে তার সময়ে।
গণনিয়োগের যে ধারা আব্দুল মান্নান শুরু করেছিলেন সেখানে আরো এক ধাপ এগিয়ে যান সৈয়দ হুমায়ূন আখতার। তিনিও বেছে-বেছে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিতে শুরু করেন। এসব নিয়ে আছে নানা অভিযোগ।
এমনকি তিনি তার মেয়ে সৈয়দা সাগিন আখতারকে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন স্কুল অব বিজনেসে। তার ভাতিজা, ভাগ্নে এবং অনেক আত্মীয় এখন বাউবিতে কর্মরত। পাশাপাশি বর্তমান রেজিস্ট্রার এবং বিভিন্ন ডিরেক্টরের আত্মীয় স্বজনকে খুশি করতে নিয়োগ দেয়া হয় বিভিন্ন পদে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব একাডেমিক প্রোগ্রামের মধ্যমণি হচ্ছেন ডিন। ফ্যাসিবাদী তাণ্ডব গিয়ে আছড়ে পড়েছে ডিন পদের উপরে সব থেকে বেশি। একবার নিয়োগ প্রাপ্তির পর নিয়ম মেনে ডিন পদে বদল করার নিয়ম থাকলেও সৈয়দ হুমায়ুন আখতার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে পর পর তিনটি টার্মে একই ব্যক্তিকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।
এসএসএইচ এলের ডিন হিসেবে সনদ জালিয়াতি ও বিক্রির অভিযোগে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলম তৃতীয় দফায় ডিন হয়েছেন। একাধিক সিনিয়র অধ্যাপক থাকার পরেও দুর্নীতিকে দীর্ঘায়িত করার দুরভিসন্ধি সামনে রেখে স্কুল অব এগ্রিকালচার অ্যান্ডা রুরাল ডেভলপমেন্ট এর ডিন হিবেবে ফরিদ হোসেন নিয়োগ পেয়েছেন তৃতীয় মেয়াদে। পেপারলেস স্কুল করার নামে প্রতিমাসে মাত্র দুই একদিন ক্যাম্পাসে আসা ওপেন স্কুলের ডিন সাবিনা ইয়াসমিনও নিয়োগ পেয়েছেন তৃতীয় মেয়াদে।
স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অবস্থা আরো করুণ। সেখানকার দুইজন ডিন অদলবদল করে যুগের পর যুগ পদ দখল করে আছেন। তাদের একজন আইসিইউ থেকে স্কুল পরিচালনা করতেন। অন্যজন এখন সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করেন কিডনিজনিত জটিলতায়। তারপরেও সেখানকার অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে ডিন হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক জানান, নিজ সন্তানের চাকরি দেয়ার পর তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেনই অভ্যন্তরীণ অনেক মোসাহেব তৈরি করেছেন বর্তমান ভিসি। তিনি কোনোভাবেই পদত্যাগের নাম নিচ্ছেন না। উপরন্ত অন্যায়ভাবে রদবদল করে তিনি নিজের অবস্থান শক্ত করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়লেও সেখানে তার দৃষ্টি নেই।
বাউবির শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন বলেন, আমরা প্রচুর টাকা খরচ করে ভর্তি হয়েছিলাম অনেক আশা নিয়ে। আমার এখন মনে হচ্ছে জীবনের সবথেকে বড় পাপ করেছি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়ে। আজ কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও এতোদিনের সেশন জটে পড়তে হতো না। শুনেছি আমাদের স্কুলের ডিন ট্যুরের টাকা কামানোর জন্য পরীক্ষা পেছানো হয়। আমাদের একাডেমিক প্রোগ্রাম নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক অধ্যাপক বলেন, মান্নান সাহেব তার ছেলে জাহেদকে লেকচারার হিসেবে না পেরে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন অন্যায়ভাবে। তাও তিনি কিছু বিল্ডিং তৈরি করেন। বাউবির চারদিকে গর্ত করে ড্রেন বানিয়েছিলেন কয়েকটা। হুমায়ূনও তার পথেই হেঁটেছেন। তিনি মেয়ে সাগিন এবং ভাতিজাকেও নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি একমাত্র দিবস পালন ছাড়া আর কিছুই করেননি।
এদিকে, ক্লাস শুরুর আবেদনসহ শিক্ষার্থীদের নানাবিধ দাবিদাওয়ার মুখে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো নীরব। গত ৫ আগস্ট থেকে ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার ও বিভিন্ন স্কুলের ডিনরা পলাতক। তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজ করছেন না। শিক্ষার্থীদের কোনো দাবি-দাওয়া কানে তুলছেন না। তারা প্রত্যেকেই আশায় আছেন একটা সময় পরিস্থিতি শান্ত হলে তারা আবার ক্যাম্পাসে ফিরে নিয়োগবাণিজ্য এবং আর্থিক কেলেঙ্কারি শুরু করবেন।
শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা ভিসি, প্রোভিসি, ডিন ও ডিরেক্টরদের এমন পলায়নপর অবস্থানে সবাই চরম হতাশ। তারা সবাই চাইছেন প্রশাসন চালাতে ব্যর্থ এই ব্যক্তিরা পদত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রশাসন পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি করে দেবেন। কিন্ত কালক্ষেপণ বাদে অন্য কোনো দিকেই দৃষ্টি নেই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মগোপনে থাকা পলাতক প্রশাসনের।
কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ভিসি সৈয়দ হুমায়ুণ আখতার ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মাহবুবা নাছরিন ফোন রিসিভ করেননি। এমনকি দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ উত্থাপিত পলাতক ডিনরাও ফোন ধরছেন না।