একটি জাতির উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নব নব তত্ত্ব ও চিন্তাভাবনা তৈরি হয় গবেষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে গবেষণা চর্চার আদর্শ প্রতিষ্ঠান হলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু সনদ প্রদান করে গ্রাজুয়েট তৈরি করা নয়, গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিক সত্ত্বা দেয়াসহ বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বজায় রাখাও এর কাজ।
বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে গবেষণা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ অপ্রতুল। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এই অপ্রতুলতার বাইরে নয়। ফলে গবেষণায় বরাদ্দ
বাড়ানোর দাবি থাকে বিশিষ্টজনের। তবে বাংলাদেশের প্রাচীনতম সেরা এ বিদ্যাপীঠ গবেষণার এই অপ্রতুল বরাদ্দের অর্ধেকও ব্যয় করতে পারেনি।গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে মাত্র ৪ কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা খরচ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্রগুলো, যা মোট বরাদ্দের মাত্র ৪৬ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র অনুসারে, বিগত পাঁচ বছরের কোনো বছরেই গবেষণা বরাদ্দের পুরোপুরি অর্থ খরচ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। পুরো দেশের নিকট সেরা বিদ্যাপীঠের এমন চিত্র যেমন অপ্রত্যাশিত ও ব্যতিক্রম তেমন হতাশারও বটে।
এই অপ্রতুল বরাদ্দের অর্ধেকও ব্যয় করতে না পারার গ্লানি নিয়েই এরই মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নে 'দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফান্ড' গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ১৬ সেপ্টেম্বর দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফান্ডটি তহবিল সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধন করেছে। উদ্বোধনের প্রথম দিনেই ১ কোটি ১১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে একটি সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে অনুদান গ্রহণের মাধ্যমে এই ফান্ডের মূলধন এক হাজার কোটিতে উন্নীত করা সম্ভব বলে আশা ব্যক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঢাবি উপাচার্যের ভাষ্যমতে, এই ফান্ড কার্যক্রম চলমান থাকবে। প্রতিবছরই একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান, ধনাঢ্য, দানবীর, শিক্ষা ও গবেষণায় অনুরাগী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুদানের চেকগ্রহণ করা হবে।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা মঞ্জুরির অর্থ মূলত বিশেষ অনুদান এবং ৫৮টি গবেষণা কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউটে দেওয়া হয়। কেন্দ্রগুলোর কয়েকটি এমনও আছে, যেগুলোতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো পরিচালক ও কার্যক্রম নেই। তবু প্রতিবছরই এগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। সেই টাকা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। কিছু কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই, কেউ কোনো গবেষণা না করেই দুয়েকটি সভা-সেমিনার করেই টাকা খরচ করছে। আবার যে কেন্দ্রগুলো ভালো গবেষণা করছে, তারা পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১টি কেন্দ্র কোনো টাকাই ব্যয় করেনি। গত দুই অর্থবছর থেকে উদ্ভাবন খাতে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এক টাকা খরচ হয়নি। চলতি অর্থবছরেও গবেষণা মঞ্জুরি খাতে মোট ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রগুলোতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২১-২২ বার্ষিক বিবরণীর তথ্যমতে, বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, সেন্টার ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম নেই। সেন্টার ফর কালচার অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো পরিচালক নিয়োগ হয়নি।
এছাড়াও সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ, ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র ও সেন্টার ফর আরবান রেজিলিয়েন্স স্টাডিজের কোনো পরিচালক নেই। ইস্ট এশিয়ান স্টাডি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন পিএসসির সদস্য হয়েছেন, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ স্টাডি অ্যান্ড রিসোর্স ইউটিলাইজেশনের পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অবসরে গিয়েছেন ছেন এক বছর হলো, কটলার সেন্টার ফর মার্কেটিং এক্সিলেন্সের পরিচালক ফারহাত আনোয়ার জুলাইয়ে অবসরে গিয়েছেন। এসব কেন্দ্রে এখনও কোনো পরিচালক নিয়োগ না হওয়ায় কোনো কার্যক্রম নেই। এগুলোতে প্রতিবছর বরাদ্দ হচ্ছে আর তা অব্যয়িত থেকে যাচ্ছে।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টার থেকে ২০১৯ সালে আটজন শিক্ষক মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছেন– এ তথ্যটিই বিগত বছর ধরে উল্লেখ করে আসছে। এটির আর কোনো কার্যক্রম নেই। সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ সেন্টার, ব্যবসায় গবেষণা ব্যুরো, উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র, পলিসি অন বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস সেন্টার, উচ্চতর মানববিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, কালচার অ্যান্ড ডিসলিনেট সেন্টার, রঙ্গলাল সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, ব্যাংকিং ইন্ট্রাপনারশিপ ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি কেন্দ্রগুলো গত বছরে বেশির ভাগ বরাদ্দ খরচ করেনি।
অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইংলিশ টিচিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, বুড্ডিস্ট হেরিটেজ অ্যান্ড কালচার সেন্টার, আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ কেন্দ্র, নৈতিকতা উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর কোনোটি একটি জার্নাল, অনলাইন বা অফলাইনে সেমিনার, বিতর্ক উৎসব, চিত্রাঙ্কনেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এদের কেউই ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ করতে পারেনি।
বায়োইনফরমেটিক্স লার্নিং অ্যাডভান্সমেন্ট অ্যান্ড সিস্টেমিক ট্রেনিং সেন্টারটি শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ হাজার টাকা, শিক্ষকদের জন্য ৮ হাজার টাকা ও পেশাজীবীদের জন্য ১০ হাজার টাকায় অনলাইনে বায়োইনফরমেটিক্স কোর্স পরিচালনা করে থাকে। অ্যারাবিক টিচিং ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে জুমে দু’দিনব্যাপী কর্মশালা এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ওশান গভর্ন্যান্স সেন্টার সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ৪২ জন শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রাম নৌবাহিনী হাইড্রোগ্রাফিক ইউনিটে পরিদর্শন ও সমুদ্র গমনের ব্যবস্থা করেছে এবং আরও ছয় শিক্ষার্থীকে নৌবাহিনীর জাহাজে বঙ্গোপসাগর থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য ফিল্ড ট্রিপ করেছে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, "আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু গবেষণা হচ্ছে। যেখানে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ দিতে পারতেছি না সেখানে এমন বিষয় অনাকাঙ্ক্ষিত। কিছু দুষ্টু লোক এ নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে বিতর্ক তৈরি করতে চায়। আমরা যে অল্প বাজেটারি পাই সেগুলোর কাজ দাপ্তরিক সমস্যার কারণে অনেক সময় প্রলম্বিত হয়। বরাদ্দকৃত টাকা আমাদেরকে তিন কিস্তিতে দিতে হয়, এর মধ্যে আবার অনেক ডকুমেন্টস জমা দিতে হয় ফলে দাপ্তরিক সমস্যা হয়। অব্যবহৃত টাকা রিসার্চ ফান্ডে জমা থেকে যায়। কোনো টাকা ফেরত যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের ব্যবস্থাপনায় অনেক ত্রুটি রয়েছে, অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি নিরর্থক। সবকিছুতে গবেষক ও গবেষণাকেন্দ্রের দোষ দিলে হবে না। কিস্তির ভিত্তিতে অর্থায়ন করে দিলে ভালো গবেষণা হয় না। আমরা অনেকগুলো পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতেছি। আমি ডিএ কে বলে দিয়েছি গবেষণার টাকা কিস্তির পরিবর্তে একবারে দেওয়ার জন্য ইউজিসিকে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) চিঠি লিখতে। গবেষকের চাহিদা ও বরাদ্দ অনুযায়ী টাকা দিয়ে পাবে এবং বছর শেষে সমন্বয় করতে বলব।"
পরিচালক ও কার্যক্রম নেই এমন প্রতিষ্ঠান চালু করা হবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, "গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন করা খুব জরুরি। গবেষণা কেন্দ্রের গুণগত মানের জন্য আমরা স্বচ্ছতার দিকে যাচ্ছি। পূর্বে অপরিকল্পিতভাবে একেকজন অধ্যাপকের প্রস্তাবে অনেক গবেষণাকেন্দ্র গড়ে ওঠেছে, যেগুলোর অফিস ও জনবল কিছুই নেই। এখনো অনেকে বিদেশ থেকে এসে নতুন করে প্রস্তাব দেয়, তবে যেখানে কোয়ালিটি কাজ থাকবে আমরা সেখানেই অর্থ ব্যয় করব। যেগুলোতে কার্যক্রম, অফিস ও জনবল নেই সেগুলো টানবো কেন? আমি সমন্বয়কদের বলে দিয়েছি সেগুলো দেখতে।"