আমরা যখন মাস্টার্সে পড়ি, আমাদের ঠিক আগের ব্যাচের বড় ভাই প্রথম শ্রেণি পাওয়া মনিরুস সালেহীন টিপু আমাদের শিক্ষক হলেন। আমরা জানি আশির দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণি পাওয়া মোটামুটি একটি রেয়ার বিষয় ছিলো। একই হলে কাছাকাছি রুমে থাকতাম। গল্প আড্ডা বড় ভাইয়ের মতোই হতো। হঠাৎ স্যার হিসেবে ক্লাসে এলেন, কি বলে সম্বোধন করব? ভাই না স্যার? ক্লাসে স্যারই বলতাম। ক্লাসের বাইরে ‘ভাই’। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসেছি, এসে শুনলাম টিপু ভাই বিভাগে আর নেই, সিভিল সার্ভিসে চলে গেছেন। প্রশাসন পরিচালনার জন্য তাদের মতো মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রয়োজন।
এর সঙ্গে দ্বিতীয় আর একটি বাস্তব উদাহরণ না দিলেই নয়। উচ্চমাধ্যমিকের পরে যারা আরো স্মার্ট তারা কিন্তু কোনো উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য খুব একটা লালায়িত হন না। তারা ডিফেন্সে ঢোকার জন্য তৈরি হন, কোচিং করেন, বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন যাতে সেনা অফিসার, নেভাল অফিসার কিংবা এয়ার অফিসার হতে পারেন। কারণ হচ্ছে মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর বিভিন্ন কারণে তাদের ৭-৮ বছর সময় লেগে যায় প্রতিষ্ঠান থেকে বের হতে। বের হয়ে কিন্তু তারা বেকারের খাতায় নাম লেখান। তারপর আবার ভালো চাকরি পেতে হলে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে হয়, আবার সেই মুখস্থ। কিন্তু যারা ইতিমধ্যে ডিফেন্সে ঢুকে গেছেন তারা মোটামুটি আট বছরে মেজর/কমান্ডার/স্কোয়াড্রন লিডার অর্থাৎ রেসপনসেবল একটি পজিশনে পৌঁছে যান এবং পজিশন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকেন। আর তার বন্ধুরা বিশাল ডিগ্রি নিয়ে বেকার হয়ে অথবা তার কাঙ্ক্ষিত পজিশনের বহু নিচ থেকে শুরু করেন একটি চাকরি। ডাক্তার হলে কোনো এক ক্লিনিকে, ইঞ্জিনিয়ার হলে কোনো এক ফার্মে চাকরি শুরু করেন। আর সাধারণ বিষয়ে হলে ব্যাংক কিংবা ব্যাক্তিগত কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। তাদের ডিফেন্সের বন্ধুরা সরকারি গাড়ি করে পদে পদে স্যালূট নিচ্ছেন, পাশে আছেন সুন্দরী স্ত্রী। এখন শিক্ষার্থীরা কোনটা করবেন? আমরা তাদেরকে যদি বলি সবাই পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব কমিয়ে উপার্জন আর পদের পেছনে ছুটছেন, এটি ঠিক নয়, এটি সমাজের অবক্ষয়! তাহলে কি এগুলো থেমে থাকবে? বিসিএস যারা দিচ্ছেন তারা বিসিএস অফিসার হলেও তো তাদের ব্যাচের ডিফেন্স অফিসারদের কয়েক ধাপ নিচ থেকে চাকরি শুরু করবেন, তারা এন্ট্রি লেভেল থেকে চাকরি শুরু করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢোকার জন্য ভোর থেকে বিসিএস পরিক্ষার্থীরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। গ্রন্থাগার খোলে সকাল আটটায়, কিন্তু গভীর রাত থেকে লাইনে ব্যাগ রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এটি অনেক অর্থ বহন করে। প্রথমত, শিক্ষার্থীরা হলে নিজ রুমে বা হলের রিডিংরুমে পড়ার পরিবেশ পান না। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান চর্চার জায়গা, পড়ার জায়গা, গবেষণার জায়গা। সেগুলো আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছি না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা নিজ বিষয়ের চেয়ে বিসিএসের গাইড বা বই পড়ায় অধিকতর মনোযোগী। বিষয়কে তারা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এটি কি তাদের দোষ? অবশই না। যে যে বিষয়েই পড়াশুনা করুক, জ্ঞানার্জন করুক না কেন, তাদের সকলের একটি উদ্দেশ্য ভালো একটি কাজ যোগাড় করা, সংসার, আত্মীয়-স্বজনের, পাড়া প্রতিবেশীর জন্য কিছু একটা করা। সেই উদ্দেশ্য সফলের জন্য একটি কাজ দরকার, একটি চাকরি দরকার। চাকরিদাতারা, পাবলিক সার্ভিস কমিশন যে বিষয়ে বেশি জোর দিয়ে থাকেন, শিক্ষার্থীরা তাই করছেন। তাহলে শিক্ষার্থীদের দোষ কোথায়? যেসব শিক্ষার্থীরা রসায়ন বিভাগে পড়াশোনা করেন, তাদের চাকরি/বিসিএস পরীক্ষা যদি রসায়নের উপরই হতো, সেখানে তাদের ক্রিয়েটিভিটি কতোটা তারা দেখাতে পারেন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হলে শিক্ষার্থীরা তো আর গাইড পড়ে কোন দেশ কবে স্বাধীনতা লাভ করেছে ইত্যাদি মুখস্থ করার চেয়ে নিজেদের বিষয়ই বেশি পড়তেন। যেসব বিষয়ের ওপর বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো কোনো বিষয়ের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই একমাত্র শিক্ষা ক্যাডার ছাড়া। তাই শিক্ষার্থীরা বিসিএস গাইড পড়ছেন, এতে তাদের তো কোনো দোষ নেই।
এটি হতে পারে যিনি যে বিষয়ে পড়াশোনা করছেন সেই বিষয়ের অন্তত একটা ভালো পারসেনটেজ হতে পারে সেটি ৫০ কিংবা ৬০ শতাংশ পরীক্ষা বিষয় থেকে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা যেমন আরো ক্রিয়েটিভ হতেন, তেমনি বিষয়ের প্রতি বেশি জোর দিতেন। এখানে আবার যারা গণিতে বা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুন করেন তাদের নম্বর যারা ইতিহাস, বাংলা কিংবা ইংরেজিতে পড়েন তাদের সঙ্গে নম্বর ট্যালি করলে মিলবে না। তাই, সাধারণ বিষয়গুলোর নম্বর তুলনা করতে হবে আর বিষয়ের নম্বর বিভাগভেদে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা বই পড়া আরো ছেড়ে দেবেন। শিক্ষকরা ক্লাসে গিয়েও দেখবেন, শিক্ষার্থীরা বিষয় ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে বিসিএস গাইড নিয়ে ব্যস্ত, যেটি এখন হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে ১৯ লাখের ওপরে। এর মধ্যে কর্মরত আছে প্রায় ১৪ লাখ। তার মানে হচ্ছে প্রায় পাঁচ লাখ পদ এখন শূন্য। বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব পরীক্ষা তুমুল প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরির পড়াশোনাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, এটি অস্বাভাবিক নয়।
বেসরকারি চাকরিক্ষেত্রগুলোকে সরকারি পর্যায় থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখন যেটি হয়, বেসরকারি চাকরি যারা করেন সরকারি চাকরির কোনো প্রটোকলে তারা নেই। ফলে বেসরকারি চাকরি করা একটি প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটার সুবাদে বা পিছিয়ে পড়া জেলার নাগরিক হওয়ার কারণে যারা বিসিএসে বড় বড় পদ দখল করে আছেন আর তাদের চেয়ে বহু যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন অথচ রাষ্ট্রীয় কোনো হিসেবের মধ্যেই তারা নেই। এসব কারণে সবাই সরকারি চাকরি করতে ব্যস্ত, মহাব্যস্ত। ফলে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। তারপরের বিষয়টি হলো, বিসিএসের এসব চাকরিতে আছে সীমিত সংখ্যক পদ কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থী বের হচ্ছে অনেক। ইকুয়েশন এভাবে মেলানো যাচ্ছে না। তাই বেশি বেশি বেসরকারি চাকরিতে জোর দিতেই হবে। আর সরকারি অধিকাংশ পদই কোনো ক্রিয়েটিভ বা উৎপাদনমুখী কিছু নয়। তারপরেও সেগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খুব প্রয়োজন। কাজেই তার মূল্য থাকতে হবে। কিন্তু অন্য কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই, সবাইকে প্রশাসনিক পদ দখল করতে হবে। তাহলে সমাজকে ও সভ্যতাকে কারা টিকিয়ে রাখবেন? সবাই যদি কেরানি, উচ্চশ্রেণির কেরানি হওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাহলে নতুন বিষয় সৃষ্টি ও আবিষ্কার করবেন কারা? আমাদের প্রয়োজন প্রকৃত গবেষকের, প্রয়োজন উন্নত মানের শিক্ষকের, মানসম্পন্ন ও নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, প্রচুর কৃষিবিদ প্রয়োজন এবং তাদের গুরুত্ব থাকতে হবে অনেক বেশি, প্রয়োজন দক্ষ ও প্রকৃত সৃজনশীল প্রকৌশলী। কিন্তু কি সমাজ কি পড়াশোনা ও কি ব্যবস্থা আমরা করেছি যে, সারাজীবন ডাক্তারি পড়ে ম্যাজিজস্ট্রেট হওয়ার জন্য গাইড পড়ছেন, সারা জীবন কৃষিবিজ্ঞান পড়ে এসি ল্যান্ড হতে চাচ্ছেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে তারাও মেজিজস্ট্রেট হওয়ার জন্য পাগল। এখানেই সমস্যা! কিন্তু সমস্যা শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়। আমরা সমাজে যে ব্যবস্থা করে রেখেছি শিক্ষার্থীরা তার ভিকটিম, শুধু তাদের দোষ দিলে হবে না।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি সরাসরি রাজনীতি না করেও পদোন্নতি পেতেন, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে অবদান রাখতে পারতেন, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন, সরকারি ছাত্র সংগঠনের মাস্তানদের খুশী করতে না হতো তাহলে তো তারা আমলা হওয়ার জন্য বিশাল জ্ঞানের রাজ্য ছেড়ে সেখানে যেতেন না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভেবে এগোতে হবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেতের বিসিএস গাইড পড়ছে বলে চোখ টাটালে হবে না। কেন তারা পুলিশ অফিসার হবেন, কেন তারা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবেন এসব নিয়ে পরশ্রীকাতরতা দেখালে হবে না।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ টিম, দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা