প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় চার স্তরে জালিয়াতি করেছে ডিভাইস সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এই চক্রের কন্ট্রোল রুম বা হেডকোয়ার্টার্স ছিল রংপুর শহরের লালবাগ বড় বাজার এলাকায়। সেখান থেকেই পুরো বিভাগে অনুষ্ঠিত ওই পরীক্ষায় ডিভাইস জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চার স্তরে কাটআউট পদ্ধতিতে জালিয়াতি সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ চক্রের এক ধাপের সদস্যরা অন্য ধাপের সদস্যদের চেনে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত শুক্রবার রংপুর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে প্রাথমিকের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে বহুনির্বাচনী পরীক্ষায় ডিভাইস জালিয়াতির ঘটনায় রংপুরের ৮টি জেলায় পরীক্ষার আগে ও পরে অভিযান চালিয়ে অন্তত ১৪০ জনকে আটক করে পুলিশ ও র্যাব। পরীক্ষার্থী ছাড়াও আটকদের মধ্যে সিন্ডিকেটের সরাসরি সদস্য, শিক্ষক ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা রয়েছেন। এর পরই এই সিন্ডিকেটের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্তে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ চক্রের মূলহোতা মিন্টু নামের একজন। তবে এটি তার ছদ্মনাম বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এ পর্যন্ত আটক কেউ তাকে চেনেন না, শুধু নামটি শুনেছেন।
আটকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও উদ্ধার করা নানা আলামত যাচাই করে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার অন্তত ৩০০ পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ডিভাইস সিন্ডিকেট চুক্তি করেছিল। প্রতি পরীক্ষার্থীর সঙ্গে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় এই চুক্তি হয়। প্রথমে অগ্রিম দিতে হয়েছে ৫ লাখ টাকা করে।
পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে ও পরীক্ষার দিন রংপুর সদর এলাকা থেকে তিনজন শিক্ষক, ডিভাইস জালিয়াতি চক্রের পাঁচজন ও ১১ পরীক্ষার্থীসহ মোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান গতকাল শনিবার বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস জালিয়াতি করতে শহরের লালবাগ বড় বাজার এলাকায় কন্ট্রোল রুম খুলে বসেছিল চক্রটি। রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে এখান থেকেই জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ঘণ্টায় ৫০ হাজার টাকার চুক্তিতে প্রশ্নপত্র সমাধান করে ‘মেধাবী টিম’ : তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র চলে আসে লালবাগ বড় বাজারে সিন্ডিকেটের কন্টোল রুমে। এরপর সেখানে বসে চক্রের সদস্যরা তা সমাধান করে দ্রুত সময়ের মধ্যেই। এই সমাধানকারীদের দলে শিক্ষক থেকে শুরু করে মেধাবী ছাত্রও রয়েছে। সিন্ডিকেটের ভাষায় যারা ‘মেধাবী টিম।’ প্রশ্নপত্র সমাধানের পর অন্য সদস্যরা কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর ব্লু-টুথের সঙ্গে কন্ট্রোল রুম থেকে মোবাইল ফোন সংযুক্ত করে উত্তর জানাতে থাকে। আটক হওয়া লায়ন্স কলেজের রসায়নের শিক্ষক নুরুন্নবী ও কাউনিয়া টেপামধুপুর মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ রেজওয়ান ছিলেন এই মেধাবী টিমের সদস্য। এ ছাড়া গাইবান্ধায় আটক হয় বেসরকারি একটি কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম। তারা পরীক্ষার্থীও সংগ্রহ করে দিয়েছেন।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান জানান, মেধাবী এই টিমের সদস্যরা এক ঘণ্টার জন্য চুক্তিতে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ওই এক ঘণ্টার জন্য একজন সদস্য ৫০ হাজার টাকা করে পায়।
পুলিশ কমিশনার বলেন, পরীক্ষা শুরুর পর কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী অসাধু শিক্ষক, কর্মকর্তা বা সিন্ডিকেটের প্রক্সি পরীক্ষার্থী প্রশ্নপত্র ছবি তুলে কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দেয়। তবে তাদের এখনো পুরোপুরি চিহ্নিত করা যায়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটের মূলহোতা মিন্টু পুরো কার্যক্রমে আড়ালেই ছিল। তার নিচের স্তরে ছিল লোকাল এজেন্ট। এই এজেন্টরা পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় নানা কারণে প্রভাবশালী। এর পরের স্তুরে ছিল পরীক্ষার্থী সংগ্রাহক। তাদের দায়িত্ব বিভিন্ন এলাকা থেকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করে লোকাল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এই চক্রে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষকও কাজ করে থাকে। সর্বশেষ স্তরে থাকে থাকে পরীক্ষার্থী, যারা জালিয়াতির মাধ্যমে পাস করে শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন।