বিভিন্ন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পেলেও যোগদান ও এমপিওভুক্তি নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে প্রার্থীদের। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক পদে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া বহু প্রার্থীর কাছে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ‘চাহিদা ভুলে দেয়া হয়েছে’ দাবি করেও অনেককে যোগদান করতে দেয়া হচ্ছে না।
এদিকে নতুন শিক্ষকদের অনেকেই নিজ জেলা থেকে দুর-দুরান্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছেন। সেখানকার প্রভাবশালী সভাপতি বা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেন না তারা।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কমকর্তারা বলছেন, এরই মধ্যে ঘুষ দাবির ডজন খানেক লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। আরো বহু প্রার্থী মৌখিকভাবে অভিযোগ জানাচ্ছেন।
যদিও মনোনীত শিক্ষককে যোগদানে বাধা দেয়া ও ঘুষ দাবি করা হলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। বিধান আছে এমপিওভুক্তিতে হয়রানি করা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও। তবে সে বিধানের থোড়াই কেয়ার করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ পরিস্থিতিতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। যোগদানে ঘুষ চাওয়া প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ও প্রার্থীদের যোগদানের ব্যবস্থা করতে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। আর এমপিওভুক্তিতে ঘুষ চাওয়া শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। ঘুষ দাবির বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তাদের সতর্ক করতে অধিদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে কড়া বার্তা পাঠানো হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল সোমবার বিকেলে দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে কথা হয় টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন নিয়োগ সুপারিশ পাওয়া একজন শিক্ষিকার। যোগদান করতে তার কাছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করেছে ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ পরিস্থিতিতে তিনি দৈনিক আমাদের বার্তার কাছেও অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে শঙ্কিত ছিলেন। তার অনুরোধেই অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে বিরত থাকছে দৈনিক আমাদের বার্তা।
ওই শিক্ষিকা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এনটিআরসিএ আমাকে ওই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ করেছে, সেখানেই চাকরি করতে হবে। বদলির সুযোগও নেই। এ পরিস্থিতিতে কী বলবো তাও বুঝতে পারছি না।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া হাট স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদানে সজিবুর রহমান সজিব নামে একজন সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থী দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছেন, যোগদান করতে তার কাছে ৫ লাখ ঘুষ দাবি করা হয়েছে।
গতকাল সোমবারই অন্য এক নতুন শিক্ষক দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এমপিওভুক্তিতে ডিডি-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা-উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের ঘুষ দাবির বিষয়ে প্রতিকার চান। তবে কোন কর্মকর্তা ঘুষ দাবি করছেন তা খোলাসা করতে চাননি তিনি। তিনি বলেন, যার নামে অভিযোগ দেবো তিনি তো এ পদেই থাকবেন, আমি কি এমপিওভুক্ত হয়ে থাকতে পারবো?
শিক্ষক নিয়োগের প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকা এনটিআরসিএর শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষামান শাখার একাধিক কর্মকর্তা গতকাল সোমবার দুপুরে দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, অনেক ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, পদ খালি নেই। আবার ঘুষ না দিলে নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র দেয়া হচ্ছে না। এমপিওভুক্তিতেও ঘুষ দাবি করা হচ্ছে। তবে প্রার্থীরা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিতে ভয় পাচ্ছেন। ১২ থেকে ১৪টি লিখিত অভিযোগ এলেও অনেক প্রার্থী এনটিআরসিএ কার্যালয়ে এসে মৌখিকভাবে অভিযোগ জানাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রার্থীদের যোগদান করাতে বলছেন। একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি যোগদান করাতে ১২ থেকে ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে নতুন শিক্ষকের যোগদানের ব্যবস্থা করেছেন।
এনটিআরসিএর কর্মকর্তাদের পরামর্শ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের তদারককারী কর্তৃপক্ষ। তাই অধিদপ্তর যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের সতর্ক করে লিখিত নির্দেশনা জারি করে সেক্ষেত্রে নতুন শিক্ষকদের যোগদান ও এমপিওভুক্তিতে অসহায়ত্ব ও ভোগান্তি কমবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ গতকাল সোমবার দুপুরে দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষকদের ঘুষ চেয়ে নতুন শিক্ষকদের যোগদানে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি। এ বিষয়ে দৈনিক আমাদের বার্তার একটি প্রতিবেদনও আমাদের নজরে এসেছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। আমরা মাঠ পর্যায়ের সব শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলেছি, কোনো শিক্ষককে যোগদান করতে না দেয়া হলে ওই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে।
মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা এমপিওভুক্তির আবেদন অগ্রায়ণে ঘুষ দাবি করছেন বলে জানালে মহাপরিচালক বলেন, কেউ যদি এমনটি করেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের সতর্ক করে শিগগিরই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কড়া বার্তা পাঠনোর ব্যবস্থা করা হবে।
জানা গেছে, এমপিওভুক্ত হতে নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা শিক্ষা অফিস, এমনকি আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের হাতে শিক্ষকদের হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এক শ্রেণির অসাধু প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির সভাপতি এবং কোনো কোনো শিক্ষা কর্মকর্তা শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ নেন। অনেক সময় এমপিওর আবেদনও অযৌক্তিক বা তুচ্ছ কারণে রিজেক্ট করে দেয়া হয়। এ ভোগান্তি কমানোর উদ্যোগ নিয়ে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে একটি আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। ওই আদেশে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠান প্রধান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক উপপরিচালক-পরিচালকদের নিজ নিজ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে শিক্ষকদের এমপিও আবেদন অগ্রগামী করতে হবে। কোনো অনৈতিক সম্পৃক্ততায় এমপিও আবেদন অগ্রায়নে দীর্ঘসূত্রতার প্রমাণ পেলে প্রতিষ্ঠান প্রধান, উপজেলা-থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক উপপরিচালক ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আদেশে আরো বলা হয়, এমপিও সংক্রান্ত ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সভা আহ্বান, রেজুলেশন লেখা বা স্বাক্ষর এবং নিয়োগ সংক্রান্ত কাজে সভাপতি অনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত থাকলে ও দীর্ঘসূত্রতার প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতিসহ সভাপতির পদটি শূন্য ঘোষণা করা হবে এবং বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমপিওর আবেদন করতে শিক্ষকদের কাগজপত্র সরবরাহ বা স্বাক্ষর করতে অনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকলে বা অযৌক্তিক কারণে দেরি করলে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সভাপতিকে অব্যাহতি দিয়ে তার পদ শূন্য ঘোষণা করা হবে। একইসাথে সভাপতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।