বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। এমতাবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নাগরিকদের কৃচ্ছ্রসাধনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এরপরও নিয়মবহির্ভূতভাবে ৬৮ কোটি টাকা খরচ করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। দেশের সর্বোচ্চ অডিট প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) থেকে পরিচালিত এক অডিটে এ অনিয়ম ধরা পড়ে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ টাকা খরচ করে চবি।
সিএজির কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক খরচের ক্ষেত্রে ২৭টি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। যেখানে ১৪টি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) ও ১৩টি গুরুতর নয় এমন আর্থিক অনিয়ম (নন-এসএফআই) রয়েছে। অডিট শেষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত অডিটররা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কেই এ টাকা নিয়ম অনুযায়ী খরচ হয়েছে মর্মে প্রমাণ করতে হবে। নতুবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টাকা ফেরত দিতে হবে। এখন না দিলে পেনশন থেকে কেটে নেয়া হবে।
২৭টি শিরোনামে অডিট আপত্তির বিষয়টি উঠে আসে সিএজির অডিটে।
সেগুলো হলো- বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষকগণকে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার ৩১৬ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণকে প্রদত্ত অগ্রিম সমন্বয় করা হয়নি ৫ কোটি ৩২ লাখ ৭ হাজার ২৩৭ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করা সত্ত্বেও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন বিল হতে নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন না করায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ২২ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৯ টাকা, পদ ছাড়াই অর্গানোগ্রাম বহির্ভূত বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানপূর্বক দায়িত্ব ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ২ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬২ টাকা, ডিজিটাল লাইব্রেরি সেবার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সরকারের অনুদান মঞ্জুরি থেকে ইউজিসি কর্তৃক অনিয়মিতভাবে কর্তন ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫৬২ টাকা, সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি ২৯ কোটি ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪০ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে বিধি বহির্ভূতভাবে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত বই ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৬০৯ টাকা, দোকান ও মার্কেট ভাড়া বাবদ অনাদায়ী অর্থ আদায় না করায় আর্থিক ক্ষতি ৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৮০ টাকা, নির্ধারিত চাকরিকাল শেষ হওয়ার পরেও সেশন বেনিফিটের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিধি বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত সময়ের চাকরির সুযোগ প্রদান করে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার ১২১ টাকা, প্রদত্ত সম্মানী বিল হতে কর্তনকৃত আয়কর পরিশোধকারী কর্তৃক সরকারি কোষাগারে জমা না করায় রাজস্ব ক্ষতি ৫১ লাখ ৯১ হাজার ৫৩০ টাকা, ১ম বর্ষ সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ফি হতে প্রাপ্ত আয়ের ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা প্রদান না করায় আর্থিক ক্ষতি ৪ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৪০০ টাকা, বিধি বহির্ভূতভাবে প্রাপ্যতা ছাড়াই গবেষণা ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ৭২ লাখ ৭৩ হাজার ৬০৯ টাকা, গবেষণা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও রিপোর্ট দাখিল না করে প্রকল্পের জন্য মঞ্জুরিকৃত অর্থ অনিয়মিতভাবে ব্যয় ৬০ লাখ টাকা, সিটি করপোরেশনের এলাকার বাইরে হওয়া সত্ত্বেও কর্মচারীদের যাতায়াত ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ৫২ লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদকে অনিয়মিতভাবে চাঁদা প্রদান ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রাপ্য হার অপেক্ষা বেশি হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ৮২ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ টাকা, ইউজিসি’র নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের বেতনভাতা রাজস্ব বাজেট হতে প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার ২৫৬ টাকা, আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূত গাড়ি মেরামত বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় করায় আর্থিক ক্ষতি ১৭ লাখ ৪৮ হাজার ৮১২ টাকা, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও অনিয়মিতভাবে সময় বর্ধন করে ঠিকাদারকে সুবিধা প্রদান, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ ১৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার ৮৭৭ টাকা, পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করে আরএফকিউ পদ্ধতিতে সিলিং অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় ৪২ লাখ ৬৩ হাজার ১০৬ টাকা, প্রাপ্যতাবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অধিককাল/ওভারটাইম ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ৭৮ লাখ ৮০ হাজার ৫৬০ টাকা, অকেজো/মেরামতযোগ্য গাড়ি মেরামত/নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা না করে দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা, বিশ্ববিদ্যালয় আইন এর ধারা ৫৭ (১,২) মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক হিসাব ও ব্যালেন্সশিট
প্রস্তুত না করায় বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা লঙ্ঘন, আপাতিক ব্যয় নামে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারীগণের যাতায়াত ও আপ্যায়ন ভাতা বিধি বহির্ভূত পরিশোধ করায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩৭ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দকৃত দোকানের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল অনাদায়ী ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৫৮৪ টাকা, অনুমোদিত সংশোধিত প্রাক্কলনে নির্ধারিত কাজের পরিমাণ অপেক্ষা অতিরিক্ত কাজের পরিমাণ গ্রহণ করে ঠিকাদারকে সরকারি তহবিল হতে বিল পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ৬ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৮ টাকা। সর্বমোট ৬৮ কোটি ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৩ টাকার নিয়মবহির্ভূত খরচের প্রমাণ মিলেছে সিএজির অডিটে।জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের বলেন, অডিট আপত্তির বিষয়টি আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জানতে চাইবো। তারা যদি এ টাকা খরচের সুনির্দিষ্ট যুক্তি না দেখাতে পারেন তাহলে এটা ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় যাবে। যেখানে সিএজিও থাকবে। তারাসহ যদি এটার নিষ্পত্তি না হয় তাহলে এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে নিষ্পত্তির জন্য বসা হবে। সেখানেও যদি বিশ্ববিদ্যালয় এ টাকা খরচের যথাযথ কারণ না দেখাতে পারে তাহলে সংসদের ফাইন্যান্স কমিটিতে নিষ্পত্তির জন্য যাবে। যদি বিষয়টি নিষ্পত্তি না হয় তাহলে অবশ্যই এ টাকা ফেরত দিতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এখন না দিলে পেনশন থেকে কাটা যাবে। বিশেষ করে গুরুতর আর্থিক অনিয়মের (এসএফআই) ক্ষেত্রে মাফ পাওয়ার সুযোগ নেই। হয়তো নন-এসএফআই বিভিন্নভাবে আমরা ছাড় দিতে পারি। এখন এটা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাযথ যুক্ত হাজির করতে হবে নতুবা নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী করণীয় ঠিক হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ৬৮ কোটি টাকা অনিয়মের বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই। কোনো বিষয়ে অডিট আপত্তি থাকলে আমরা জবাব দেবো। আমরা নিয়ম মেনেই কাজ করেছি। অডিট হচ্ছে রুটিন ওয়ার্ক। সরকারের কাছ থেকে অডিট পরিচালিত হয়। তারা বিভিন্ন পরামর্শ দেন। আমরাও সেগুলো আমলে নিয়ে থাকি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. শিরিন আখতারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।