চাটমোহরের স্কুলটি পেল স্থাপত্যনকশায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার - দৈনিকশিক্ষা

চাটমোহরের স্কুলটি পেল স্থাপত্যনকশায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

ইট-পাথর–ইস্পাতের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ, কাঠ ও মাটি। শিক্ষার্থীরা যাতে প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে উঠতে পারে, তার জন্য চারপাশটা রাখা হয়েছে সবুজ আর ছায়া ছায়া। এমন একটি স্থাপত্যনকশার জন্য গত সপ্তাহে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের দুটি পুরস্কার জিতেছে পাবনার চাটমোহরের বড়াল বিদ্যানিকেতন। স্কুলটি দেখতে গিয়েছিলেন সরোয়ার মোর্শেদ

হেমন্তের সকালে হাজির হয়েছিলাম চাটমোহরের কুমারগাড়া গ্রামে, বড়াল বিদ্যানিকেতনে। পথেই দেখেছি শিশুরা ব্যাগ কাঁধে স্কুলের দিকে ছুটছে। স্কুলে পৌঁছে তারা প্রথমে সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করল। শ্রেণিকক্ষের নির্ধারিত বক্সে ব্যাগটি রেখে সবাই চলে এল বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।

সেখানে ধর্মগ্রন্থ পাঠ, জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে দেশের জন্য শপথবাক্য পড়ানো হলো। এরপর কিছুটা শারীরিক কসরত শেষে সার ধরে আবার শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ল শিক্ষার্থীরা। সুরে-ছন্দে শুরু হলো পড়া।

আমি তখন স্কুল ভবনটা ঘুরে ঘুরে দেখছি। আধুনিকতা আর ঐতিহ্য—দুইয়ের মিশেলে তৈরি হয়েছে এই ভবন। ব্যবহার করা হয়েছে ইট, কাঠ, বাঁশ ও মাটি। দুই দিকে দুটি একতলা আর মাঝখানে একটি দ্বিতল ভবন। একতলা ভবন দুটির ওপরে মাটির টালি, নেই কোনো জানালা। তবে আছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। সামনের দিকে ইটের গাঁথুনি এমনভাবে করা হয়েছে, ফাঁকা দিয়েই আলো ঢুকছে। আর পেছন দিকটার ওপর অংশ খোলা। রোদ–বৃষ্টি সবই মিলছে। শিক্ষার্থীরা রোদের দিনে আলো, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি উপভোগ করতে পারছে।


দ্বিতল ভবনটি আরো অন্য রকম। নিচতলাটা পুরো ফাঁকা। জানালা–দরজা কিছুই নেই। বাঁশের চাটাইয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে শিক্ষামূলক বিভিন্ন ছবি। মাঝখানে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাঠাগার। শীতল কক্ষটিতে থরে থরে সাজানো বই। ভবনটির দুই দিকে সিঁড়ি। একদিক দিয়ে শিক্ষার্থী দোতলায় ওঠে, অন্য দিক দিয়ে নেমে আসে। দোতলাটাও পুরো খোলামেলা। দুই পাশে লম্বা বারান্দা। মাঝখানে পাঁচটি শ্রেণিকক্ষ। কক্ষগুলোর প্রবেশদিকে দরজা। বিপরীত দিকে স্লাইড। প্রয়োজনে যা আটকে রাখা যায়, আবার পুরো খুলেও দেয়া যায়। ক্লাস চলাকালে কক্ষের এক দিক পুরোই খোলা রাখা হচ্ছে। আর ভবনের সামনে রয়েছে আম, লিচু, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফল-ফুলের বাগান।

ক্লাস চলছিল। ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো স্কুলটার স্থাপত্যশৈলীই শুধু সৃজনশীল না, এর শিক্ষাব্যবস্থায়ও রয়েছে ভিন্নতা। গতানুগতিক ধারার বাইরে পড়ানো হচ্ছে হেসেখেলে। অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা—সব পড়াতেই যেন সুরের তাল। একজন শিক্ষক জানালেন, এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি শেখানো হয় নাচ, গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও বিতর্ক। আছে কম্পিউটার ল্যাব। সবার প্রয়াস, আনন্দ নিয়ে যেন বেড়ে উঠতে পারে শিক্ষার্থীরা।

তাই পঞ্চম শ্রেণির জান্নাতুল ফেরদৌস বলছিল, তাদের স্কুলটা আলাদা। এখানে কেউ বকাঝকা করে না। ভুল করলে শিক্ষকেরা হাসিমুখে ঠিক করে দেয়। বুঝিয়ে বলে, তাই তারা খুব সহজেই সবকিছু বুঝতে পারে। ভালো লাগে।

স্কুলটিতে বর্তমানে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। প্রতিবছর একটি করে শ্রেণি বাড়ছে। শিক্ষার্থী রয়েছে ২৮১ জন। শিক্ষক ১৭ জন। নামমাত্র বেতন দেয় শিক্ষার্থীরা, যা তাদের টিফিন বাবদ ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের পোশাক থেকে শুরু করে বাকি খরচ বহন করেন স্থাপত্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘ভিত্তি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হাবিব ও তাঁর পরিবার। শিক্ষকেরাও নামমাত্র বেতনে শ্রম দেন। প্রচণ্ড ভালো লাগা ও ভালোবাসা থেকে তাঁরা স্কুলে পড়াতে আসেন বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক দিল আফরোজ বেগম। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে কে ডাক্তার হলো, কে ইঞ্জিনিয়ার হবে, সেটা আমরা ভাবি না। চাই, সবাই ভালো মানুষ হোক। আমরা সেভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

যাত্রা শুরু যেভাবে

বড়াল নদটি চলনবিলের প্রাণ। চাটমোহর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বড়াল অপরিকল্পিত বাঁধ ও দখল-দূষণে মরা খালে পরিণত হচ্ছিল। এভাবে একটি নদী হারিয়ে যাবে? তখন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) স্থানীয় সচেতন কিছু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নদী রক্ষার আন্দোলন শুরু করে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটি। আন্দোলনকে বেগবান করতে বড়ালপারের বাসিন্দাদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু করে কমিটি। কাজটি করতে গিয়েই বড়ালপারের মানুষের দুঃখ–দুর্দশা স্বচক্ষে দেখে তারা। দারিদ্র্য ও দুর্গমতার কারণে অনেক শিশুকে স্কুল ছেড়ে মাঠে কাজ করতে দেখে তারা। অনেকে আবার স্কুলে গেলেও কিছু শিখতে পারছে না।

বিষয়টি নাড়া দেয় কুমারগাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব মিজানুর রহমানকে। তিনি স্ত্রী দিল আফরোজ বেগমের সঙ্গে আলোচনা করেন। দুজনই উচ্চশিক্ষিত মানুষ। ঢাকায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। কাঁধে নিয়েছেন বড়াল রক্ষার কর্মসূচি। গ্রামের শিশুদের পড়ানোর জন্য স্ত্রীকে অনুপ্রেরণা দিলেন মিজানুর রহমান। দিল আফরোজও অনুপ্রাণিত হয়ে বাড়িতেই শিশুদের পড়ানো শুরু করলেন। দিন দিন বাড়তে থাকল পড়তে আসা শিশুর সংখ্যা।

২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে কথা। মিজানুর-দিল আফরোজ দম্পতি ভাবলেন এবার একটা স্কুল দরকার। কিন্তু এ জন্য তো অর্থ দরকার। এগিয়ে এলেন দিল আফরোজ বেগমের ছোট বোন প্রয়াত শাহনাজ বেগম। বড় বোনকে ১০ লাখ টাকা দিলেন তিনি। সেই টাকাতেই একটি টিনের ঘর তোলা হলো।

গল্পে গল্পে এভাবেই বিদ্যালয়টি বেড়ে ওঠার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন মিজানুর রহমান। জানালেন, টিনের ঘরে মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্কুল। স্কুলটির নাম দেওয়া হলো ‘বড়াল বিদ্যানিকেতন’। শিক্ষার্থী বাড়ায় পরে আরও একটি টিনের ঘর তোলা হয়।

স্কুলটি আরো বড় হবে
বড়াল ও চলনবিল রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। সেই সুবাদে বহুবার চলনবিল এলাকায় এসেছেন বাপার সহসভাপতি ইকবাল হাবিব। এমনই এক সফরে স্কুলটি পরিদর্শনে এসে হতবাক হয়ে যান এই স্থপতি। টিনের ঘরে বরেন্দ্র অঞ্চলের তপ্ত গরমে ক্লাস করছে শিশুরা। বিষয়টি তাঁকে কষ্ট দেয়। স্কুলটি উন্নয়নের পরিকল্পনা করেন তিনি।

ইকবাল হাবিব জানান, চলনবিল ও বড়ালপারের বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক। বহু মানুষের বাড়িতে তিনি সানকিতে ভাত খেয়েছেন। পরিবেশ রক্ষায় গ্রামের এই বাসিন্দারা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের সন্তানেরা মানসম্মত পরিবেশ পায়নি। তাই মানুষগুলোর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই স্কুলটি আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেন। সহযোগিতার হাত বাড়ান বন্ধু ও স্বজনেরা।

স্কুলের জন্য নিজেই একটি নকশা করেন ইকবাল হাবিব। স্কুলের নামে পৈতৃক এক একর জমি লিখে দেন মিজানুর রহমান। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে  জুনে শুরু হয় স্কুল ভবন নির্মাণের কাজ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শেষ হয় কাজ। সেই থেকে নতুন ভবনে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা।

স্থাপনাটি প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, গতানুগতিক ধারার বাইরে পরিবেশবান্ধব ও খোলামেলা পরিবেশের কথা মাথায় রেখে স্কুলটির নকশা করা হয়েছে। এখানে জানালা নেই, কিন্তু আলো আছে। বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুঁতে পারছে তারা। শান্তিনিকেতনের আদলে ভবনের সামনে তিনটি আমগাছ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে আবদ্ধতার বিপরীতে উন্মুক্ততা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আবহমান বাংলার মাটি ও বাংলার উঠানের পরিবেশটাকে ধারণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যাতে শিশুরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবেসে বেড়ে উঠতে পারে।

স্কুলটির নকশা তিনটি স্তরে বাস্তবায়িত হবে। প্রথম স্তর শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি দুই স্তর হবে। সেই নকশার জন্যই দুটি শ্রেণিতে এবার আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস (এআইএ) আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। নান্দনিকতা ও বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য নকশাটি এই পুরস্কার পেয়েছে।

প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান বলেন, পরিবেশবান্ধব ও মানবিক মানুষ গড়ার জন্যই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শিশুরা আনন্দ নিয়ে পড়ছে। প্রকৃতির সঙ্গে বেড়ে ওঠায় পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি তাদের ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে। পুরোপুরি নির্মাণকাজ শেষ হলে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা হবে। অন্য এলাকার শিক্ষার্থীরা এখানে এসে পড়তে পাড়বে। অন্যদিকে স্কুলের আয় দিয়েই স্কুল চলবে।

ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041458606719971