আসামি পক্ষ কর্তৃক উচ্চ আদালতে জাল-জালিয়াতির ঘটনা নতুন নয়। একের পর এক এই জালিয়াতির ঘটনা ধরাও পড়ছে। কখনো আসামি মামলার এজাহার, তদন্ত প্রতিবেদন বা জব্দ তালিকা বদলে ফেলছেন। আবার জামিন না পেয়েও প্রস্তুত করছেন জামিনের জাল আদেশ। এমন ঘটনায় উচ্চ আদালতের কঠোর অবস্থান বার বার পরিলক্ষিত হলেও থামছে না জাল-জালিয়াতির ঘটনা। এবার ভয়ানক এক জালিয়াতির সন্ধান মিলেছে। যেখানে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা না দিয়েই আসামি সৃজন করেছেন প্রায় দেড় কোটি টাকার ব্যাংকের জাল চালানের কপি। সেই জাল কাগজ দিয়েই চেক প্রত্যাখানের মামলার সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন হাইকোর্টে। এমন ভয়ানক জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি আসামির। ধরা পড়েছেন উচ্চ আদালতে। এছাড়া এই জালিয়াতির সঙ্গে আপিলকারীসহ কারা জড়িত তা তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ।
হাইকোর্ট বলেছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জাল চালান দাখিল করে আপিলকারী যে দুঃসাহস দেখিয়েছে তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া আবশ্যক। আপিলকারী এই দুঃসাহসিক কাজ একা করেনি। একটি দুষ্ট চক্র তাকে সহায়তা করেছে। এই চক্রের মুখোশ উন্মোচন করা জরুরি। আমরা মনে করি যে কোনো মূল্যে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল এই সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
২ কোটি ৮১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০৬ টাকার চেক প্রত্যাখাত হওয়ায় মো. ফজলুর রহমান সোয়েবের বিরুদ্ধে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মামলা করে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল)। এই মামলায় দ্য নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় আসামিকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও চেকে উল্লিখিত ২ কোটি ৮১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০৬ টাকা জরিমানা করে মৌলভীবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। পরবর্তীকালে আপিল দায়েরের শর্তে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি আসামিকে জামিন দেওয়া হয়। পরে সাজা ও জরিমানার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামি। যার নম্বর ২৭২/২০২২। আইনানুযায়ী চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় আপিল করতে হলে দণ্ডিত আসামিকে চেকে উল্লিখিত টাকার অর্ধেক পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু দণ্ডিত আসামি ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়েই সৃজন করেছেন সোনালী ব্যাংকের জাল চালান। সেই চালান দিয়েই হাইকোর্টে করেন আপিল।
যেভাবে উদ্ঘাটিত হলো জালিয়াতির ঘটনা:
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ নভেম্বর মৌলভীবাজার সোনালী ব্যাংকের শাখায় প্রায় দেড় কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে বলে আদালতকে অবহিত করে আসামি পক্ষ। জমাকৃত ঐ টাকা ব্যাংকের অনুকূলে আনতে সোনালী ব্যাংককে চিঠি দেয় ইউসিবিএল কর্তৃপক্ষ। তখন সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ইউসিবিএল ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানায় যে, এই পরিমাণ টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি। এরপর এ বিষয়ে সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য সোনালী ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন চায় মৌলভীবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ব্যাংক থেকে প্রতিবেদন দিয়ে বলা হয়, চালানে উল্লিখিত টাকা সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা হয়নি। অর্থাত্ চালানটি সঠিক নয়। এরপরই দায়রা আদালতের নির্দেশে জালিয়াতির বিষয়টি বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চকে অবহিত করেন মামলা দায়েরকারী ইউসিবিএল ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কৌঁসুলি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী আককাছ চৌধুরী। তিনি শুনানিতে বলেন, এই ধরনের ভয়ানক জালিয়াতি রোধে আসামির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এভাবে জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে উচ্চ আদালত নিয়ে জনমনে আস্থা হ্রাস পাবে।
হাইকোর্ট গত এপ্রিল মাসে আপিল খারিজ করে জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। কমিটির প্রধান হলেন হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার সিনিয়র জেলা জজ মুন্সি মো. মশিয়ার রহমান। তদন্তে তাকে সহায়তা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধী শনাক্তের পাশাপাশি আপিলকারী সোয়েব ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামললা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেছেন, এটা কাঁচের মতো স্পষ্ট যে, আপিলকারী ফজলুর রহমান সোয়েব ভুয়া চালান জমা দিয়ে আপিলটি করেছেন।