ছাড়পত্র চাওয়ায় রাজশাহীর বেসরকারি শাহ মখদুম মেডিক্যাল কলেজের প্রধান ফটক বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। শুক্রবার সকালের এ ঘটনায় কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন চিকিৎসা নিয়েছেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। আহত এক শিক্ষার্থী কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নগরের চন্দ্রিমা থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন।
জানা যায়, দীর্ঘদিনেও নিবন্ধন না পাওয়ায় কলেজটির ৪২ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাই তারা ছাড়পত্র চেয়েছিলেন অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে। এ জন্য প্রধান ফটক বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া দুই শিক্ষার্থী হলেন, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের মেহেদী হাসান মুন্না ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের সাইমন ইকবাল নিরব। এই দুই শিক্ষাবর্ষের ৪২ জন এমবিবিএস শিক্ষার্থী ভর্তির পর থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) ও বিএমডিসির নিবন্ধন পাচ্ছেন না। প্রতারণা করে ভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। এ নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ২৩টি মামলাও করেছেন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শাহ মখদুম মেডিক্যাল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীন, তার ভাই টিটু ও মিঠুসহ ভাড়াটে লোকজন তাদের ওপর হামলা করেছেন। ঘটনার সময়ের ভিডিয়ো দেখা যাচ্ছে, কলেজের অনুসন্ধান ডেস্কের সামনে বসে আছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীন। কয়েকজন শিক্ষার্থী একটি ছাড়পত্র লিখে নিয়ে গিয়ে তার হাতে দিয়েছেন। এই ছাড়পত্রে সই করে দেয়ার জন্য তারা অনুরোধ করছেন।
এক শিক্ষার্থী বলছেন, আপনি আমাদের জন্য কিছু করতে পারবেন না স্যার। আপনার দ্বারা সম্ভব না। আপনি এই এনওসিতে স্বাক্ষর করে দেন। আমরা অন্য কোথাও ভর্তি হয়ে যাই। এ সময় মনিরুজ্জামান স্বাধীন বলেন, তোমার কথায় তো আমি করব না। তোমাদের যে বক্তব্য সেটা আমাকে লিখিত দাও। তখন শিক্ষার্থীরা ছাড়পত্রে সই দেওয়ার জন্যই অনুরোধ করেন। এ সময় মনিরুজ্জামান বলেন, আমি যেটা বলছি সেটা করতে হবে।
প্রতারণার মামলা করা এক শিক্ষার্থীকে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে মনিরুজ্জামান স্বাধীন বলেন, তুমি না মামলা করেছ? তুমি আমার সামনে থেকে সরে যাও। এ সময় পাশে থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন স্বাধীনের ভাই টিটু। মামলা করা এক শিক্ষার্থীকে গালি দিয়ে বলেন, তুই আমাকে জিনিস না? তুই আমাকেও মামলায় আসামি করেছিস কেন? এরপরই শিক্ষার্থীদের ধাক্কা দেওয়া শুরু হয়। পরে ধাওয়া দিয়ে ধরে ধরে শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়।
আহত শিক্ষার্থী সোহেলুল হক বলেন, আমরা গিয়ে বলেছিলাম স্যার আমাদের জীবনটা বাঁচান স্যার। তিন বছরেও আপনি কিছু করতে পারেননি। আমরা এনওসি এনেছি। আপনি সাইন করে দেন। এনওসিতে লেখা ছিল, আমরা যেহেতু ওদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করতে পারছি না। অন্য কোথাও পড়াশোনা করলে আমাদের আপত্তি নেই। এই এনওসিতে তিনি সাইন করলেন না। দুটি গেট বন্ধ করে এলোপাতাড়ি মারা হলো। মেয়েদেরও মেরেছে।
মেহেদী হাসান মুন্না বলেন, পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তারা প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হন। এমবিবিএস প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তির জন্য কেউ দিয়েছেন ১৫ লাখ, কেউ ১৮ লাখ টাকা। এরপর নিবন্ধন না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ২৩টি মামলা করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তাতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলা করার পর ছাড়পত্র চাওয়ায় তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় তারা মামলা করছেন।
নগরের চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিয়ার রহমান বলেন, কলেজে ঠিক কী ঘটনা ঘটেছে, বিস্তারিত জানি না। মারধরের অভিযোগে কলেজের এক শিক্ষার্থী থানায় এজাহার দিয়েছেন। সেটা মামলা হিসেবে রেকর্ড করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শাহ মখদুম মেডিক্যাল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান স্বাধীন বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো ভিডিও দেখাচ্ছে। তারা যেগুলো করেছে সেই ভিডিও দেখাচ্ছে না। ফলে আমরাই অপরাধী হয়ে যাচ্ছি। আমরা শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমরা ভুক্তভোগী হয়েছি, এখনো হচ্ছি।
মনিরুজ্জামান স্বাধীন আরো বলেন, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে। তবে মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশের কার্যকারিতা উচ্চ আদালত স্থগিত করেন। ফলে তারা দুটি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন না দেয়া হলে শিক্ষার্থীরা প্রথমে উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। উচ্চ আদালত আদেশ দিয়েছেন, এই শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন দিতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তারপরও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নিবন্ধন দিচ্ছে না। ফলে কলেজে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।
কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিযোগ করেন, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক জাওয়াদুল হক একটি রাজনৈতিক দলের মানুষ। সেই দলের চিকিৎসকদের একটি অংশ স্বল্প টাকায় শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ কিনে নিতে চাচ্ছেন। এ কারণে উপাচার্য তাঁদের নবন্ধন না দিয়ে হয়রানি করছেন, যাতে তিনি প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
জানতে চাইলে রামেবির উপাচার্য অধ্যাপক জাওয়াদুল হক বলেন, কারা এই প্রতিষ্ঠান কিনতে চায়, সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আসলে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার নিবন্ধন দিতে গেলে বেশ কিছু ক্রাইটেরিয়া দেখতে হয়। আমি বলেছি, এসব ঠিক থাকলে নিবন্ধন দিয়ে দেব। কিন্তু মনিরুজ্জামান স্বাধীন কোনো নিয়ম-নীতির মধ্যেই আসতে চান না। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটিতে জটিলতা চলছে। আমরা নিবন্ধন দিতে পারছি না।