আজ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। প্রতিবছর দিবসটির একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। এবারের (২০২৩) প্রতিপাদ্য হচ্ছে,‘স্মার্ট গ্রন্থাগার..স্মার্ট বাংলাদেশ’।এই স্লোগান বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের আলোকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
গত ২৪ ডিসেম্বর (২০২২)অনুষ্ঠিত বর্তমানে আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষনে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে চারটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো:স্মার্ট সিটিজেন,স্মার্ট ইকোনমি,স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। সরকার দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে।তাঁর ভাষায়,স্মার্ট বাংলাদেশের অর্থ হচ্ছে, দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি,যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন,আমাদের শিক্ষা,স্বাস্থ্য,কর্মযোগ্যতা’সবকিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে।ই-এডুকেশন,ই-হেলথসহ সবকিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ নাগাদ আমরা তা করতে সক্ষম হবো এবং সেটা মাথায় রেখেই সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য,স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষে শেখ হাসিনার শর্ত, বিশ্বখ্যাত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনকে সামনে রেখেই প্রণীত বলে প্রতীয়মান হয়। স্মার্ট সিটিজেন,স্মার্ট ইকোনমি,স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত যে স্মার্ট এডুকেশন এবং স্মার্ট লাইব্রেরী সে কথা বলাই বাহুল্য।
সবাই বিশ্বাস করেন,এই দিবস পালনের মাধ্যমে সকল স্তরের জনগণ, ছাত্র-শিক্ষক,গবেষক সবাই বইপড়ার গুরুত্ব অনুধাবন এবং নিজেদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নততর ফলাফল অর্জন করবেন এবং সার্বিকভাবে জীবন মানের উন্নতি ঘটাবেন।গ্রন্থাগার ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক সমাজপ্রতিষ্ঠার এই কাজ আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশানুযায়ী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের এজেন্ডা মাথায় রেখে অগ্রসর হই,তাহলে স্মার্ট গ্রন্থাগার স্থাপনের আর কোনো বিকল্প নেই।
ছাত্রছাত্রীদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির লক্ষে সরকার প্রতিদিনকার নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় লাইব্রেরী আওয়ার’ চালু করেছে।বিষয়ভিত্তিক ক্লাসের মতো প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীরা পালাক্রমে গ্রন্থাগারে গিয়ে কমপক্ষে এক ঘন্টা পড়াশুনা করবেন।‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’ ঘোষণার ফলে দেশের সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে গ্রন্থাগারসংক্রান্ত কার্যাদি অধিকতর বেগবান হচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করেন।
একটি জাতির মেধা ও মনন, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও লালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। সেজন্য বলা হয়,গ্রন্থাগার হলো সমাজ উন্নয়নের বাহন। আমাদের দেশের সরকার প্রধানরাও গ্রন্থাগারের
প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিভিন্ন সময় গ্রন্থাগারমুখী ব্যাপক উন্নয়ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অনেক সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেরে বাংলা নগরে ‘বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার’।রাজধানীর শাহবাগে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠাও তাঁরই পরিকল্পনার অংশ।১২-১৩ বছরে দারিদ্র্য দূরীকরণ, উৎপাদনশীলতা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাত, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা সার্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয়েছে।২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশসমূহের তালিকায় নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছে।২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জ্ঞানসূচক তৈরিতে সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।এগুলো হলো,প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা,গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সাধারণ সক্ষমতার পরিবেশ।
অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা,গবেষণা, গ্রন্থাগার ব্যবস্থা..এ সবকিছুতেই সংস্কার আনা প্রয়োজন। অন্য সব আলোচনার আগে আজ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে গ্রন্থাগার উন্নয়নের বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। তার আগে আমাদের গ্রন্থাগারসমূহের বিদ্যমান চিত্র কিছুটা সামনে আনা যায়।বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন জানা যায়,বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালসমূহের গ্রন্থাগারের অবস্থা সবচেয়ে ভালো।কোনো কোনো গ্রন্থাগার বিশ্বমানের এবং এগুলোকে যথার্থভাবে স্মার্ট গ্রন্থাগার বলা যেতে পারে। সরকারী-বেসরকারী ছোট বড় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই গ্রন্থাগার রয়েছে, রয়েছে কমবেশি প্রশিক্ষিত জনবল ও পাঠসামগ্রী। যদিও এগুলোর কয়েকটি বাদে বাকীগুলোকে স্মার্ট গ্রন্থাগারে রূপান্তরের জন্যে প্রশিক্ষিত জনবল ও তথ্য- প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে এর পাশাপাশি আছে অত্যন্ত করুণ চিত্রও !
নওগাঁ জিলা স্কুলের লাইব্রেরির আলমারিতে ধুলা জমে আছে।লাইব্রেরীটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ।নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, পড়ার সুযোগ পাবো কীভাবে? লাইব্রেরী তো খোলাই হয় না! স্কুলের হেড ক্লার্ক জিয়া বলেন, সরকারি স্কুলে লইব্রেরিয়ানের পদ নেই। একজন শিক্ষককে লাইব্রেরী পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া আছে।
রাজশাহী মহানগরীর একাধিক মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের গ্রন্থাগারিক জানান, প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের জন্য আলাদা একটি ফান্ড আছে। যার নামমাত্র একটি অংশ গ্রন্থাগারের কাজে লাগানো হয়। বাকি অর্থ খরচ করা হয় অন্য খাতে।এ জেলার বাঘায় মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ রয়েছে ৬৪টি। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরিয়ান থাকলেও নামমাত্র আছে লাইব্রেরী।আড়ানী ইউনিয়নের খোর্দ্দবাউসা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিফ বলেন, লাইব্রেরিয়ান আছে, কিন্তু লাইব্রেরী নেই। কিছু বই আছে স্টাফ রুমের আলমারিতে রাখা ।
নাটোরের সিংড়া উপজেলায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরীর বেহালদশা।জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসাবে পরিচিত সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজে লাইব্রেরীর কোনো নির্দিষ্ট রুম নেই।ওই প্রতিষ্ঠানের ভোকেশনাল শাখার একটি রুমে দরজার ওপর ইংরেজিতে লাইব্রেরী লেখা থাকলেও সেটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ। পাশেই বিএনসিসির শিক্ষার্থীদের একটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরে লাইব্রেরীর বইগুলো কয়েকটি আলমিরাতে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ধুলোর আস্তরণ দেখে বোঝা যায়, দীর্ঘদিনেও এগুলো খোলা হয়নি।
একই জেলার বাগাতিপাড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পাঠাগার কক্ষটিতে ডিজিটাল ল্যাব বানানো হয়েছে। সেখানকার কর্মচারীরা জানালেন, বইগুলো গোডাউনে রাখা হয়েছে।
যমুনার ভাঙনকবলিত চৌহালী উপজেলা সদরে একটি সরকারি কলেজ ও খামারগ্রাম ডিগ্রি কলেজসহ আরও তিনটি কলেজ রয়েছে। এছাড়া তিনটি কারিগরি কলেজ, ২৩টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং প্রায় ২০টি মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
পাবনার সুজানগরে একটি সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়সহ ৩৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি সরকারি কলেজসহ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৯টি।এর মধ্যে নব্বই ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই লাইব্রেরী।যে কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী আছে সেগুলোও দীর্ঘদিন তালাবদ্ধ!
স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি, এক কথায় স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষার সর্বস্তরে পড়াশুনার মান আমাদের বাড়াতেই হবে।সেই সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার।পড়াশুনার মান তখনই বৃদ্ধি পাবে-যখন ছাত্রছাত্রীরা নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি গ্রন্থাগারে গিয়ে বিষয়সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত রেফারেন্স বই পড়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। অন লাইনে শিক্ষক প্রদত্ত ওয়েবসাইট (একাধিক হতে পারে) ঘাটাঘাটি করে নিজের জ্ঞানস্তরকে সমৃদ্ধ করবেন। স্মরণ রাখতে হবে,আমাদের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উচ্চ জিপিএ অর্জন করার পরও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় একই পাঠক্রমের ওপর করা প্রশ্নপত্রের উত্তরে আশানুরুপ ফলাফল করতে পারছেন না।অন্যতম কারণ হচ্ছে..আমাদের ছাত্রছাত্রীরা গ্রন্থাগারে পড়াশুনা, রেফারেন্স বইপড়া, ওয়েবসাইট সার্চ করে পড়াশুনা তো দূরের কথা,নিজেদের পাঠ্যপুস্তকও সঠিকভাবে পড়ে আয়ত্ত করেন না। তারা গাইড বা নোট পড়ে পাস করেছেন। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসে আমাদের পরামর্শ হচ্ছে,ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক ও গ্রন্থাগারভিত্তিক পড়াশুনায় মনোনিবেশ করানো।শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পড়াশুনার সম্পর্ক দৃঢ়তর করা এবং স্মার্টফোনকে অর্থবহ কাজে লাগানো।প্রতিটি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা অনুমোদনের শর্তানুযায়ী যথানিয়মে গ্রন্থাগার পরিচালনা এবং সরকারী নির্দেশ মোতাবেক এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
লেখক:উপদেষ্টা,গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ