আমাদের বার্তা ডেস্ক: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা। জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মাতা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। পিতার চাকরির সুবাদে জামিলুর রেজা চৌধুরীর শৈশবকাল কেটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৩
ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার পেশাগত কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান, সিভিল ইঞ্জনিয়ারিং অনুষদের ডিন এবং বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণের পর প্রফেসর চৌধুরী বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। উপাচার্য হিসেবে তার সৃজনশীল ও সুযোগ্য নেতৃত্বে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে অন্যতম অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক-এর উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ পদে নিয়োজিত ছিলেন।
অধ্যাপনা ও শিক্ষা প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অধ্যাপক চৌধুরী জাতীয় পর্যায়ের এবং জাইকা, ইউএনএসস্ক্যাপ (UNESCAP)-সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। প্রকল্পসমূহের মধ্যে রয়েছে উঁচু ভবন, শিল্প-কারখানা ভবন, ট্রান্সমিশন টাওয়ার, বিমানের হ্যাঙ্গার, স্টেডিয়াম, বন্দর ও জেটি, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটারাইজেশন ইত্যাদি। বাংলাদেশের মাল্টিপারপাস সাইক্লোন শেল্টার প্রতিষ্ঠা প্রকল্পের টিম লিডার হিসেবে প্রফেসর চৌধুরী উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টারগুলোর জন্য মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছিলেন। তিনি এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ পদ্মা বহুমুখী সেতুর টেকনিক্যাল কমিটির আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ-লীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও, বাংলাদেশের প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, কর্ণফুলী নদীর বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পরামর্শক ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রস্তুত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে গঠিত প্রধানমন্ত্রীর টাস্কফোর্সের একজন র্যাঙ্কিং সদস্য ছিলেন।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছাড়াও বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি; বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি; বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা); বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দারিদ্র্য বিমোচন, পরিচিতিহীনতা জনিত সমস্যা দূরীকরণ এবং নিপীড়ন হতে মুক্তির জন্য কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বি.এফ.এফ)-এর ট্রাস্টি এবং পরে চেয়ারম্যান ছিলেন।
দেশি-বিদেশি গবেষণা জার্নালে প্রফেসর চৌধুরীর ৭০টিরও অধিক গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশনার বিষয়বস্তুর মধ্যে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, কম খরচে আবাসন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা তৈরি, ঘূর্ণিঝড় এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাস সহনীয় কাঠামো নির্মাণ, কাঠামোর পুনরুদ্ধার, কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন এবং আইসিটি নীতি সম্পর্কিত বিষয়াদি অন্যতম। উল্লেখ্য যে, প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সুউচ্চ ভবনের শিয়ার ওয়াল (Shear wall) বিশ্লেষণের জন্য একটি সহজ পদ্ধতির উদ্ভাবক। এ পদ্ধতিটি ‘Cull and Choudhury’s Method’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এ পদ্ধতিটি এখন বিশ্ব জুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সিভিল ইঞ্জনিয়ারিং-এর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেক পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তার প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে শেলটেক পুরস্কার; বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন স্বর্ণপদক; ড. রশিদ স্বর্ণপদক; রোটারি সিড অ্যাওয়ার্ড; লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল (ডিস্ট্রিক-৩১৫) স্বর্ণপদক এবং জাইকা স্বীকৃতি পুরস্কার অন্যতম। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রফেসর চৌধুরীকে জাপান সরকারের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান (গোল্ড রে ও নেক রিবন) পদক-এ ভূষিত করা হয়। পুরকৌশল বিষয়ে পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স (বাংলাদেশ), ইনস্টিটিউশন অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স (ইউ.কে.), বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস, বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার কর্তৃক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং (অনারিসকসা) ডিগ্রি লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি একটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ সম্মান অর্জন করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তার অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে তাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরীকে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করে।
প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশ ব্লক চেইন অলিম্পিয়াডের উপদেষ্টা ছিলেন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বাংলাদেশ ব্লক চেইন অলিম্পিয়াড পুরস্কার-এর নাম পরিবর্তন করে ‘অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী চ্যাম্পিয়ন্স অ্যাওয়ার্ড' রাখা হয়। বাংলাদেশে পুরকৌশল জগতের এ কিংবদন্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল ভবনের নাম পরিবর্তন করে ‘ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী পুরকৌশল ভবন’ নামকরণ করা হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্মরণে আলোর পথযাত্রী (বিকন অব লাইট) শিরোনামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে।