বিউটিফিকেশনের নামে তুরাগ নদ ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে। নদী বিষয়ক সংগঠন ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, এ কাজে সাড়ে আটশ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে কোমর কষে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
এই টাকায় প্রথমে পাড় থেকে বেশ এগিয়ে নদীর বুকে সীমানা পিলার বসিয়ে প্লাবন ভূমি খেয়ে ফেলা হচ্ছে। করে দেয়া হচ্ছে তুরাগ দখলের সুযোগ। তারপর জীবন্ত সত্তা ঘোষিত তুরাগের বুকে পাইলিং করে বসানো হচ্ছে কংক্রিটের স্থায়ী ওয়াকওয়ে। বৈধতার মোড়কে পোরা এই হঠকারী প্রকল্প বারোমাসি প্র্রবাহের তুরাগকে নালায় পরিণত করার পটভূমি রচনা করছে।
তারা আরো বলছেন, এই ওয়াকওয়ের মাধ্যমে একদিকে ঢাকা শহরের জলাভূমি ব্যবস্থাপনা হুমকিতে পড়বে, অন্যদিকে লাভবান হবে বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি। অববাহিকা দখল করে হাউজিং গড়া ভূমিদস্যুরা এখন নিরাপদ। তাদেরকে আর উচ্ছেদ করা যাবে না। ওয়েকওয়ের কারণে তাদের দলখদারিত্ব বৈধতা পেলো।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার ভিত গড়ে দেয় তুরাগ। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ আদালতের এক রায়ে এই নদীকেই প্রথম জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেয়া হয়। একই সঙ্গে দেশের আর সব নদীকেও একই মর্যাদার অধিকারী করা হয়। সেই রায়ে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামাল লেখেন, তুরাগ নদী দখল দুষণ এতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, নদীটিকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে আমরা এটিকে আইনি ব্যক্তি ঘোষণা করছি।
আদালতের ওই যুগান্তকারী রায়ের পর নদী পাড়ের মানুষ আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন। ঢাকা নদী বন্দরের চার নদীর তীরভূমি উদ্ধার অভিযানে নামে বিআইডব্লিউটিএ। উচ্ছেদের মাধ্যমে তীরভূমির বিপুল পরিমাণ জায়গা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত তীরভূমি পুনরায় দখল ঠেকানোর কথা বলে সীমানা খুঁটি স্থাপনসহ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভূমি উন্নয়নে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় সীমানা খুঁটি স্থাপন করে নদীর প্রবাহ ও প্লাবন ভূমিকে বেঁধে ফেলা হয়। বর্তমানে ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও ১৪টি জেটি তৈরিসহ নদী তীরভূমিকে পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলমান।
এর আগে নৌপরিবহন মন্ত্রী থাকাকালে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো খনন করে নৌ সার্কুলার রুট চালুর কথা বারবার বলেছিলেন শাহজাহান খান। সে অনুযায়ী কিছু অংশে ওয়াটার বাস সার্ভিসও চালু হয়েছিলো। তবে কিছু দিন পরই ওই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ওয়াটার বাস।
এদিকে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উচ্ছেদ অভিযান চললেও কোনো নদীকেই পুরোপুরি দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। বরং অনেক স্থানেই পুনরায় আরো প্রভাবশালী কারো নদী দখলের ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বালু নদীকে ছয় মাসের মধ্যে দখল ও দূষণ মুক্ত করার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে বালু ও টঙ্গী নদীর সংগম স্থল তেরমুখ থেকে তুরাগের গাবতলী পর্যন্ত ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ জোর কদমে চলছে। আর তুরাগ ভরে গেছে রাক্ষুসে সাকার ফিশে। শুকনো মৌসুমে নদীপাড়ে দুর্গন্ধে টেকা যায় না। অসহায় দিন পার করছেন জেলে ও বেদেসহ বিভিন্ন নদীজীবী সম্প্রদায়। নদীকে দূষণ মুক্ত না করে পাড়ে ওয়াকওয়ে গড়ে পর্যটন প্রসারের বুলি তাই মাঠে মারা যাবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও প্রকল্পের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হচ্ছে, এটি জনগণের কাঙ্ক্ষিত একটি প্রকল্প। নদীর জন্য, নদী পুনঃদখল রোধে বা নদীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং নদীর পাড়ে একটি নৌ পর্যটন পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে এ প্রকল্পটি ঢাকাবাসীর অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। এ প্রকল্প যতো দ্রুত দৃশ্যমান হবে, মানুষের আস্থার জায়গাটা ততোই বৃদ্ধি পাবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
তবে এমন দাবি উড়িয়ে দিয়ে বংশপম্পরায় নদীপাড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ মানিক দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এই প্রকল্পে নদীপাড়ের মানুষ নয়, ভূমিদস্যুদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে। সরকার বলেছে নদীর জায়াগা নদীকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু, এই ওয়াকওয়ে নদী দখল করেই হচ্ছে। নদীর ভেতরে পাইলিং করে। এটা তুরাগ, বালু, বুড়িগঙ্গাকে শেষ করে দেবে। এর মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলোর মুখ যারা বন্ধ করেছে তারা বৈধতা পেয়ে গেলো।
মানিক বলেন, যেখানে ওয়াকওয়ে হচ্ছে, বিভিন্ন কোম্পানির হাউজিং আছে। আগে তারা ভয়ে ছিলো। কখন জানি উচ্ছেদ হয়ে যেতে হয়। এখন তারা আনন্দিত। ডোবা জমি, নদীর জমি দখল করে তারা হাউজিং করেছে। ফলে যে জমির কাঠা ছিলো ৫ লাখ টাকা সেটা এখন ৫ কোটি হয়ে গেছে।
এই প্রকল্প প্রসঙ্গে রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিআইডিব্লিউটিএ। উচিত ছিলো পাড়ে ওয়াকওয়ে গড়া। কিন্তু গড়েছে নদীর ভেতরে। এমনিতে সীমানা পিলার নিয়ে বিতর্ক আছে। দশ হাজারের মধ্যে পাঁচ হাজার পিলারেই দখলকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তারপর ওয়াকওয়ে আরো অনেকটাই খেয়ে দিয়েছে নদীর বুক। এর মাধ্যমে বস্তুত আমরা আরো নদী দখলের সুযোগ করে দিলাম। স্থানীয় জনগোষ্ঠী এটার সুবিধাভোগী না। এটার নির্মাণ কাজ মাঝেমধ্যেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বাধার মুখে পড়েছে। কোথাও কোথাও পুলিশ প্রহরায় নির্মাণ কাজ শুরু করতে হয়েছে। এর আগেও আমরা এমন ওয়াকওয়ে দেখেছি। যেগুলো বিড়ম্বনা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। আগের ওয়াকওয়ে ও নতুন ওয়াকওয়ের ডিজাইন একই।
মোহাম্মদ এজাজ আরো বলেন- বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে পর্যটনের প্রসার ঘটবে। কিন্তু পর্যটন মানে তো কেবল হাঁটার জায়গা না। অন্যান্য অবকাঠামো কোথায়। বসার জায়গা তো নেইই, কোনো গাছপালাও লাগানো হয়নি। এখন পর্যন্ত যেটুকু নির্মিত হয়েছে, সেখানে কেউ হাঁটতে যায় না। গেলে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরার সদস্য সচিব শরীফ জামিল দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আদালত যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলো তা না মেনে সীমানা পিলার দেয়া হয়েছে নদী পাড় ও ঢালকে অগ্রাহ্য করে। এর মাধ্যমে নদীর পাড় দখলদারদের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারপর নদীর বুকে গড়া হচ্ছে ওয়াকওয়ে।
শরীফ জামিল বলেন, নদীর তলদেশে পাইলিং করে ওয়াকওয়ে হচ্ছে। তুরাগের প্লাবন এলাকাকে বলা হচ্ছে মিশ্র এলাকা। সেই এলাকা দখল করে নদীকে খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদীর এতো ভেতরে জেটি গড়াও তো ঠিক হচ্ছে না।
তুরাগ সুরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাসুদ উল হক সর্দার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, এই ওয়াকওয়ের কারণে তুরাগের প্রবাহমানতা পরিবর্তন হবে। এরই মধ্যে বাঁধের এ পাড়ে শহর হয়ে গেছে। এই ওয়াকওয়ে হচ্ছে বাঁধ থেকৈ নদীর আরো ভেতরে। জেটি হচ্ছে আরো ভেতরে।
এ প্রসঙ্গে বিআইডাব্লিউটএ-এর স্টেট ও আইন পরিচালক মোহাম্মদ আরিফ উদ্দিন দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, জেটি তো নদীর মধ্যেই হয়। নৌযান থেকে মালামাল ওঠানোর সুবিধার জন্য ড্রেজিং করে নদী গর্ভ থেকে দূরে জেটি গড়া হচ্ছে।
ওয়াকওয়ের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি ওই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এদিকে ওয়াকওয়ের কারণে যেহেতু ঢাকা শহরের খালগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে, তাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) জলাভূমি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে এ প্রকল্পটি পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা জানতে চাওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলামের কাছে। দৈনিক আমাদের বার্তাকে তিনি বলেন, এটা তো বিআইডাব্লিউটিএ করেছে, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে রক্ষার জন্য। ওয়াকওয়ে করেছে, মানুষ যাতে হাঁটতে পারে। তবে প্লাবন ভূমিতে কোনো স্থাপনা করতে হলে হাইড্রলজিক্যাল এনালাইসিস অবশ্যই করে নিতে হয়। যাতে কোনো প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়। জানি না তারা সেটি করেছে কি না। লেখক: জাকারিয়া মন্ডল
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।