ডেপুটি কমিশনারের (ডিসির) বাংলা পরিভাষা উপকমিশনার। তবে সারা দেশের ডিসিদের বলা হয় জেলা প্রশাসক। এ জেলা প্রশাসক পদবি ব্যবহারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা হয় দেড় যুগ আগে। রিটে জেলা প্রশাসক পদবি ব্যবহারের বৈধতা চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ করা হয় ডিসিদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগের বৈধতাও। উচ্চ আদালত ডিসিদের ‘জেলা প্রশাসক’ পদবি ব্যবহার ও ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসেবে নিয়োগে আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তুলে রুল জারি করেন ২০০৬ সালে। ওই রুলের আজও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০২০ সালে একবার রায়ের জন্য দিন ধার্য হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর রায় হয়নি। নতুন এক সম্পূরক রুল জারি হয়েছে। ফলে পদবি হিসেবে জেলা প্রশাসক ব্যবহার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ নিয়ে যে আইনগত প্রশ্ন তুলেছেন উচ্চ আদালত, দেড় যুগেও তার মীমাংসা হয়নি।
গত সপ্তাহে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) উপজেলা পরিষদের পরিবর্তে উপজেলা প্রশাসন ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। যদিও রায়টি আপাতত স্থগিত রেখেছেন চেম্বার বিচারপতি। হাইকোর্টের ওই রায়ের পর ডিসিদের জেলা প্রশাসক পদবি ব্যবহারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। যদিও জেলা প্রশাসক পদবি ব্যবহার নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। এ কারণে উচ্চ আদালত থেকে বিষয়টির একটি সমাধান দ্রুত হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ডিসিরা মোটেই প্রশাসক নন, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও রাষ্ট্র যখন চলত আমলাদের শাসনে, তখনো ডিসি ছিলেন একজন পাবলিক সার্ভেন্ট। আর এখন তো সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। রাষ্ট্রের সব কর্মচারীই এখন জনগণের সেবক (সার্ভেন্ট অর্থে)। আমলাদের নিয়োগ দেয় যে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, তার নাম পাবলিক সার্ভিস কমিশনই, অন্যকিছু নয়। আর আমাদের সংবিধানে তো (অনুচ্ছেদ ২১) প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশই রয়েছে যে, তারা ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা’ করাকে কর্তব্য জ্ঞান করবেন। প্রজাতন্ত্রের ‘কর্মচারীরা তা হলে ‘প্রশাসক’ হন কীভাবে?
তিনি আরও বলেন, ‘ইংরেজিতে নামটি ডিসি; ইংরেজ আমলে ডিসিরা ছিল ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। তাদের দায়িত্ব ছিল খাজনা ও ট্যাক্স সংগ্রহের তদারকি করা। পাকিস্তান আমলে জমিদারি প্রথা উঠে যায়, খাজনা সংগ্রহও রাজস্ব আয়ের প্রধান অংশ থাকেনি; ট্যাক্সের জন্য অন্য সব দপ্তর তৈরি হয়েছে। তাই ডিসিরা আর ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর থাকেননি, ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার হয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের বাঙালিকীকরণ ঘটেছে। জেলা কমিশনার হয়েছেন জেলা প্রশাসক। অনুবাদ যে যথার্থ হয়নি, সেটা বলাই যাবে, শুধু যে শব্দার্থের দিক থেকে তা-ই নয়, ভাবার্থের দিক থেকেও। ভাবার্থের দিক থেকেই বরং অধিক। প্রশাসন পর্যন্ত চলতে পারে, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বাংলা হিসেবে; কিন্তু ‘প্রশাসক’ একেবারেই অগ্রাহ্য।’
জানা গেছে, বাংলাদেশ আনসারের ৩৪ আনসার ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার ১৯৮৪ ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা একেএম খাদেমুল ইসলাম বাদী হয়ে রিট করেন। রিটে ২০০৬ সালের ১৮ মে তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও বরগুনার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। রিটে তৎকালীন সংস্থাপন বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বরগুনার ডিসি (জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (মাঠ প্রশাসন-৩)কে বিবাদী করা হয়।
রিটে বলা হয়, সংবিধানের ৭, ২২, ২৭, ৩১, ১১১, ১১২, ১১৬ এবং ১১৬(এ) এবং বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায় লঙ্ঘন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বরগুনার ডিসিকে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বরগুনা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিসিএস ক্যাডার। তারা শিল্প ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি (উপসচিব) হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তাদের বদলি সুবাদে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। দেশের এ দুই জেলা এবং অন্য ৬২ জেলায় আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনে কিছু কর্মকর্তা যেমন উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা পর্যায়ে ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) এবং বিভাগীয় পর্যায়ে বিভাগীয় কমিশনার নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন। তারাও সবাই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের আওতাভুক্ত।রিটে বলা হয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকাশনায় বিভিন্ন ইংরেজি পদবির পাশে বাংলা পদবির পরিভাষা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালের প্রকাশনায় ইউএনও’র বাংলা পরিভাষা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ডিসির বাংলা পরিভাষা ডেপুটি কমিশনার এবং ডিভিশনাল কমিশনারের বাংলা পরিভাষা বিভাগীয় কমিশনার উল্লেখ রয়েছে। ১৯৯৬ সালের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তৈরি করেছে। সেখানে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব বিভিন্ন সেকশনের দায়িত্বে, দুই-তিনটি শাখার সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্রাঞ্চের দায়িত্বে উপসচিব, দুই বা ততোধিক ব্রাঞ্চের সমন্বয়ে গঠিত একটি উইংয়ের দায়িত্বে যুগ্ম সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন অতিরিক্ত সচিব ও সচিবরা। যখন কোনো মন্ত্রণালয়ে সচিব থাকেন না, তখন অতিরিক্ত সচিবকে ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত সচিব ও সচিব হলে মন্ত্রণালয়ের মুখ্য হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং মন্ত্রী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।
রিটে আরও বলা হয়, সারা দেশে বিভিন্ন পদবির (র্যাংকের) ও ক্যাটাগরির ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী। ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির, দ্বিতীয় শ্রেণির ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও পদায়ন করা হয় জেলা পর্যায়ে। এ ছাড়া মহানগর পর্যায়ে মুখ্য মহানগর হাকিম, অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম ও মহানগর হাকিমদের নিয়োগ করা হয়। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের কারণে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার শর্তে সব ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ হয় বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার থেকে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক না হওয়ার কারণে এভাবে নিয়োগ হয়। কিন্তু ডিসিদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বরগুনার ডিসিকে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রের বিরোধী। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারী জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন, শাসক বা প্রশাসক হিসেবে নয়।
আগের রিটের রায় ঘোষণাকালে এ সার্কুলারটি সামনে এলে রিটকারীপক্ষ একটি সম্পূরক আবেদন দেয়। এরপর একই বছরের ৫ মার্চ একই বেঞ্চ একটি সম্পূরক রুল জারি করেন। রুলে ডেপুটি কমিশনারের পরিবর্তে জেলা প্রশাসক নামকরণ কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না এবং ডিসির বাংলা পরিভাষা ডেপুটি কমিশনার ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। তিন সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। ২০২১ সালে মামলাটি রায়ের পর্যায় থেকে ফের আংশিক শ্রুত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি মামলাটি আংশিক শ্রুত এবং ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতবি রাখেন। এরই মধে ৯ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ফলে মামলাটির আর শুনানি হয়নি। মামলাটি শুনানির উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২৯৬ বার কার্যতালিকায় এসেছে। কিন্তু হাইকোর্টে শুনানি শেষ করা সম্ভব হয়নি।
আইনজীবীরা বলছেন, একটি রিটের নিষ্পত্তি দেড় যুগেও না হওয়া দুঃখজনক। এ ধরনের পুরোনো মামলাগুলোর দিকে প্রধান বিচারপতির নজর দেওয়া উচিত।
এই রিট মামলার আইনজীবী সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ‘বারবার চেষ্টা করেছি; কিন্তু বিভিন্ন কারণে রায়ের পর্যায়ে যাওয়ার পরও রায় হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে বারবার সময় আবেদন দিয়ে সময়ক্ষেপণ করেছে। এখন রিট আবেদনটি নতুন কোনো বেঞ্চে শুনানির জন্য উত্থাপন করা হবে।’
রিটকারী খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকেই সরকারি কর্মচারীদের শাসক/প্রশাসক পদবি ব্যবহার বন্ধ করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু কোনো ফল না পেয়ে উচ্চ আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করি। ২০০৬ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট একটি রিট করি। যার নং ৭৯০৭/২০০৬। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এরই মধ্যে ১৭ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও কোনো বিচার পাইনি। যখন এ রিট করি, তখন আমার বয়স ছিল ৪৬ বছর। এরই মধ্যে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। জীবিত থাকাকালে রায় দেখে যেতে পারব কি না, তা অনিশ্চিত।’