ইউক্রেইন ও ফিলিস্তিনের ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতাশালী দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের অভিজ্ঞতা জানাতে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসে জার্মানিতে বিশ্ব নেতাদের ওই সম্মেলনে স্পষ্টভাষায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানোর বিষয়টি তুলে ধরার কথা জানান তিনি।
ওই সম্মেলনের ফাঁকে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তিনি যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে পেলেও একইভাবে কথা বলবেন।
তিনি বলেন, “আমি ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি যে, যুদ্ধটা কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা আমাকে বলেন। আমার সোজা প্রশ্ন ছিল, যুদ্ধ কীভাবে বন্ধ করা যায়, এটাতেতো সবাই কষ্ট পাচ্ছে; মহিলা, শিশু, যুব সমাজ কত জীবন দিচ্ছে।”
“রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা হলেও সেই একই কথাই আমি বলব যে, আমি যুদ্ধ চাই না, আপনি যুদ্ধ বন্ধ করেন। আমি আমার কথা বলে যাব, তারপর কেউ বুঝলে বুঝুক, আমার কিছু আসে যায় না।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের পর জেলেনস্কির কী উত্তর ছিল, এক সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, “উনি অনেক ব্যাখ্যা দিলেন, কী কী হয়েছে, অনেক কিছু।”
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জার্মানিতে যান শেখ হাসিনা, ফেরেন ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকজন বিশ্ব নেতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয় এই সফরে।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ, ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল থানি এবং ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটি ফ্রেডরিকসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
এই সফরে বিভিন্ন আলোচনায় শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধ এবং গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান জানান।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং জার্মান ফেডারেল অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন মন্ত্রী সভেনজা শুলজেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রথম এই সংবাদ সম্মেলনে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কৃষি উৎপাদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন শেখ হাসিনা।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি যেটা বলেছি, সেটা স্পষ্ট। আমি বলেছি, আমি যুদ্ধ চাই না। কারণ, যুদ্ধকালীন যে কষ্ট আমরাতো তার ভুক্তভোগী। আমি নিজেইতো ভুক্তভোগী। কাজেই আমার দেশের মানুষ যেভাবে গণহত্যার শিকার হয়েছে, সেগুলিতো আমরা জানি।
“কাজেই যেখানে যুদ্ধ হয়, আমি বলি যুদ্ধ আমরা চাই না, আমরা শান্তি চাই। ওখানেও যেটা বলেছি, আজকে গাজায় যেটা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের উপর যেটা হচ্ছে, এটাতো অমানবিক কাজ। হাসপাতালগুলির উপর আক্রমণ, হাসপাতালে যেয়ে সেখানে মানুষকে মারা, বাচ্চাদের কি দুরবস্থা! এটা কি মানবতাবিরোধী না? এটাতো মানবতাবিরোধী।”
ক্ষমতাশালী দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা দেখি যে, বিশ্ব মোড়লরা দুদুখো নীতিতে বিশ্বাস করে। এক জায়গায় ফিলিস্তিনের সমস্ত জমি দখল করে ফেলছে, ওটা ইনভেশন না, আর ইউক্রেইনেরটা ইনভেশন। তো, দুমুখো নীতি কেন হবে, সেটা আমার প্রশ্ন ছিল।”
অন্যদের দ্বিমুখী নীতির বিপরীতে নিজের স্পষ্ট অবস্থানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি জানি, অনেকে স্পষ্ট করে বলবে না সাহস করে। নানা জনের নানা দুর্বলতা থাকে, আমারতো কোনো দুর্বলতা নাই। আমারতো চাওয়া পাওয়া নাই, আমার কাছে ক্ষমতাটা হল, ‘থাকে লক্ষ্মী, যায় বালাই’ বলে একটা কথা আছে না... আমার কাছে সেটাই।
“থাকলে ভালো, আমি দেশের জন্য কাজ করতে পারছি। না থাকলে আমার কোনো আফসোস নাই। আমার একটা লক্ষ্য ছিল ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে, বাংলাদেশকে একটা ধাপ তুলতে হবে, আমি সেটা করে দিয়েছি। আর এখন আমি ক্ষমতা আসব কি আসব না, আমিতো পরনির্ভরশীল হয়ে করি নাই। আমার একমাত্র নির্ভরতা হচ্ছে, আমার দেশের জনগণ।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি সবসময় চেয়েছি, জনগণের সমর্থন, জনগণের সহযোগিতা পেয়ে… হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হবেই আমার দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হবে, এখনতো বিশ্বটা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ।”
ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ তার প্রেক্ষাপটে নিষেধাজ্ঞা এবং গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বব্যাপী পড়ার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশে এখন মুদ্রাস্ফীতির যন্ত্রণা পাচ্ছে, সেটা ইউরোপ-আমেরিকা সব জায়গায়, কোনো জায়গায় নাই তা না, প্রত্যেক জায়গায়।
“যন্ত্রণা সবাই ভোগ করছে। কষ্টতা সব দেশের সাধারণ মানুষের হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর পরে যখন অর্থনীতিটা একটু উঠে আসছিল, কিন্তু ইউক্রেইন এবং গাজায় যুদ্ধ মিলিয়ে সারা বিশ্ব আজকে কষ্ট পাচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাব ও ক্ষতিকর দিকটা একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকছে না।”
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গা সংকটের সময় মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধে না যাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা তো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি, ওদের সাথে যুদ্ধে যাইনি, মিয়ানমারের সাথে ঝগড়াও করতে যাইনি। আমরা ধৈর্য ধরেছি, আলোচনা করছি এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি যে, তারা ফেরত নিক।
“এখনও যে অবস্থাটা বিরাজ করতেছে, আমি আমার সহকর্মীদের বলেছি, ধৈর্য ধরে আমরা লক্ষ্য রাখব, কোনো কিছুতে আমাদের উত্তেজিত হলে চলবে না, শান্ত মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে এবং সেটা করে আমরা কিন্তু সুফল পাচ্ছি।”
দক্ষিণ এশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ ‘এখনও সুস্থ অবস্থায় বিরাজ করছে’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অন্য দেশগুলো সবাই কষ্ট পাচ্ছে। এটাই হল বাস্তবতা।
“এজন্য বলি, যত পারেন ফসল উৎপাদন করেন, নিজের ভাত নিজে খাব, নিজের মাছ নিজে খাব, নিজের ঘরে নিজে থাকব, কারও কাছে আর হাত পেতে চলতে হবে না। এটাই আমার কথা।”
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ফেরাতে না পারার মধ্যে মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি শান্তভাবে মোকাবেলা করার কথা বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। আসলে মিয়ানমারের অবস্থাই এত খারাপ, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যখন কথা বলি, সকলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়, কিন্তু আসলে ফিরিয়ে নেওয়া বা ফিরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ভালো একটা কার্যকর কিছু হচ্ছে না।
“আর যুদ্ধ বন্ধের কথা যাদেরকে বলি, তারা সমর্থন করে, কিন্তু উদ্যোগটা নেবে কে? এটাও একটা প্রশ্ন। যারা বিশ্ব মোড়ল, তারাই যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আর বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে? কিন্তু এখানে সেটাই হল সমস্যা, কে বন্ধ করবে? কারণ, তারা নিজেরই হোতা।”
বিশ্ব রাজনীতিতে মধ্যমপন্থী দেশগুলো নিয়ে কোনো মোর্চা গড়ে তোলার পরিকল্পনার বিষয়ে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই, আমি এই কথাটাই বলি। কিন্তু কোনো প্ল্যাটফর্ম বা এ ধরনের কিছু করবার মত, সেই দক্ষতা আমার নাই, যোগ্যতাও আমার নাই, চিন্তাও আমার নাই। এটাই হলো বাস্তবতা।
“আমি মনে করি, আসলে অনেক প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেছে, আসলে কাজের সময় কাজে লাগে না। সেটাই হল বাস্তব।”
গাজায় নারী-শিশুদের হত্যা এবং হাসপাতালে হামলার মধ্যে যুদ্ধের বন্ধের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভিটো দেওয়ার প্রসঙ্গও টানেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের যুদ্ধ চলার সময় আমরা এটা দেখেছি।”