বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক ড. আহমদ শরীফ এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের করণিক। খ্যাতনামা পুঁথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন তার চাচা এবং করিম দম্পতির স্নেহ-আদরেই গড়ে ওঠে আহমদ শরীফের ভবিষ্যৎ জীবন।
আহমদ শরীফের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ হয় পটিয়া হাই স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। লাকসাম পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে বাংলার অধ্যাপকরূপে তার কর্মজীবন শুরু হয়। কিছুদিন তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের কর্মসূচি নিয়ামক ছিলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করেন এবং পরে এ বিভাগের শিক্ষক হন। মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ওপর গবেষণা করে তিনি ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকালের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, কলা অনুষদের ডীন, সিন্ডিকেট সদস্য এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর অধ্যাপনা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছরের জন্য নজরুল অধ্যাপক পদে সমাসীন ছিলেন।
অধ্যাপক শরীফের চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছয়শ পুঁথি দান করেন। সেগুলি অবলম্বন করেই আহমদ শরীফের গবেষণা-জীবনের সূচনা হয় এবং অচিরেই তিনি পুঁথিপাঠে পারদর্শিতা অর্জন করেন। সে থেকে আজীবন তিনি পুঁথি নিয়ে ভেবেছেন এবং বহু উল্লেখযোগ্য পুঁথি সম্পাদনাও করেছেন। বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ তারই সম্পাদিত ষোল শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁর লায়লী-মজনু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেরও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ তার সম্পাদিত পুঁথি পরিচিতি। এতে সাহিত্যবিশারদ প্রদত্ত ছয়শ পুঁথির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আছে। অধ্যাপক শরীফ মধ্যযুগের চল্লিশোর্ধ্ব কাব্যের পুথি সম্পাদনা করেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: আলাওলের তোহফা ও সিকান্দরনামা, মুহম্মদ খানের সত্য-কলি-বিবাদ-সংবাদ, মুসলিম কবির পদসাহিত্য, জয়েনউদ্দীনের রসুলবিজয়, মুজাম্মিলের নীতিশাস্ত্রবার্তা, মধ্যযুগের রাগতালনামা, বাঙলার সূফীসাহিত্য, আফজল আলীর নসিহতনামা, বাউলতত্ত্ব, সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ, রসুলচরিত ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও পুঁথি গবেষণাসূত্রে অধ্যাপক শরীফ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতা অর্জন করেন এবং এ ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। তিনি তার গবেষণা ও ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের অবদানের যথার্থ পরিচয় তুলে ধরেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নে অধ্যাপক শরীফের অনন্যতা এখানে যে, তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালির সাধনাকেই অসাম্প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন। ফলে তার বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য (দুখন্ড ১৯৭৮, ১৯৮৩) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। এটি তার শ্রেষ্ঠ রচনা। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি ক্ষেত্রে যেমন, প্রাচীন বাংলার সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্ম, বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগতত্ত্ব, প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, বাউল সাহিত্য, মুসলমান রচিত প্রণয়োপাখ্যান ও শাস্ত্রগ্রন্থ, সুফিসাহিত্য, ধর্ম সমন্বয়ের সাহিত্য, দোভাষী পুঁথি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যাপক শরীফ মৌলিক মতামত ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন। মধ্যযুগের সাহিত্য বিষয়ে তার আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সৈয়দ সুলতান: তার গ্রন্থাবলী ও তার যুগ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য।
অধ্যাপক শরীফ একদিকে যেমন ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বনামধন্য শিক্ষক ও গবেষক, অন্যদিকে ছিলেন দেশের অন্যতম বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ। লেখার জগতে তার পদার্পণ ঘটে চল্লিশের দশকে। সে থেকে আমৃত্যুই তিনি লিখেছেন। তার লেখার প্রধান এলাকা ছিলো বাংলাদেশ, বাঙালি সমাজ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলাদেশ ও বাঙালি সত্তার স্বরূপ সন্ধানে তার লেখাগুলো অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি দেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ধর্ম, ভাষা, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন। সাহিত্যের তত্ত্বগত চিন্তা ও বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট রূপকারেরা যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ তার লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে। অন্যদিকে তিনি সমাজ-প্রগতির একজন পর্যবেক্ষকও ছিলেন। প্রতিদিনের বৈশ্বিক ও দৈশিক ঘটনাবলি তার লেখকসত্তাকে নিয়ত আলোড়িত করত এবং তিনিও সেভাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের চলমান জীবন সম্পর্কে। এসব নিয়ে তিনি শেষ জীবনে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। হয়তো তার কোনো কোনো লেখা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু তার সব লেখাই চিন্তা ও প্রশ্ন উদ্রেককারী।
অধ্যাপক শরীফ ছিলেন একজন যুক্তিনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমনস্ক, মানবকল্যাণকামী, শ্রেয়োবাদী ও প্রগতিশীল লেখক। বাংলাদেশের সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন সময়ে যে প্রবন্ধগুলি রচনা করেছেন তার সংকলন গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশোর্ধ্ব। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: বিচিত চিন্তা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা, স্বদেশ অন্বেষা, জীবনে সমাজে সাহিত্যে, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা, যুগ যন্ত্রণা, কালের দর্পণে স্বদেশ, বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তন ধারা, বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র, মানবতা ও গণমুক্তি, বাঙলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব, প্রগতির বাধা ও পন্থা, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা, স্বদেশ চিন্তা, জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা, বিশ শতকে বাঙালি, বিশ্বাসবাদ, বিজ্ঞানবাদ, যুক্তিবাদ, মৌলবাদ ইত্যাদি। গবেষণা, প্রবন্ধ ও চিন্তামূলক রচনার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, দাউদ সাহিত্য পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একুশে পদক এবং কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি লাভ করেন।
একজন নিঃস্বার্থ ও নির্ভীক বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সমাজের অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করেন। অন্যায় ও গণবিরোধী কাজের জন্য তিনি যেকোনো সরকারেরই তীব্র সমালোচনা করতেন। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদী অপকর্মের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সেনাশাসন, স্বৈরাচার এবং স্বাধীনতার শত্রুদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সবসময় কঠোর ভাষায় কলম চালিয়েছেন এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। এজন্য তিনি সরকার ও ধর্মান্ধদের রোষানলে পড়েন। তার লিখনে ও ভাষণে প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষুব্ধ হতেন, কিন্তু প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রীরা অনুপ্রাণিত হতেন। চিন্তা-চেতনায় অধ্যাপক শরীফ ছিলেন শ্রেয়োবাদী ও বামঘেঁষা। তিনি ছিলেন সামাজিক উপযোগিতাবাদী লেখক। আজীবন তিনি মানবতাবাদী, দেশহিতৈষী ও প্রগতিপন্থি বিভিন্ন সংঘ, সমিতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১-এর মার্চে পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূর্ব বাংলার লেখকদের শপথ বাক্য পাঠ করান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি যেসব সভা-সমিতির কেন্দ্রীয় ব্যক্তি ছিলেন সেগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো: মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ ভাষা সমিতি, কর্নেল তাহের সংসদ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট, স্বদেশ চিন্তা সংঘ ইত্যাদি।
আহমদ শরীফ ছিলেন একটি সফল কর্মময় জীবনের অধিকারী। তার গবেষণাব্রত, লেখার জ্ঞানগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং তার দেশহিতৈষিণী চিন্তা তাকে আমৃত্যু সক্রিয় রেখেছিলো। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার মরদেহ উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য।