ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) দলীয় ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ চাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই চান মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ শিক্ষার্থী। এর সংস্কার চান ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র রাজনীতির কোনো গুরুত্ব নেই বলে মনে করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ শিক্ষার্থীই কোনো দলীয় ছাত্র রাজনীতি না চাওয়ার কারণ হিসেবে পূর্বের গণরুম ও গেস্টরুম কালচার, টর্চার সেল, জোরপূর্বক রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করানোকেই দায়ী করছেন।সম্প্রতি চালানো ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতি ও রাজনৈতিক কার্যক্রম বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিমত’ শীর্ষক ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটির এক গবেষণা জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেন সংগঠনটির সভাপতি ও প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ফাহিম হাসান মাহদী, তামান্না আক্তার শান্তা ও নির্জনা ইসলাম।
এ সময় মো. মনোয়ার হোসাইন, মো. দিদারুল ইসলাম, নাইম চৌধুরী, মো. আবির হোসেন অনিক, হুমায়রা আনজীর, একেএম প্রবাল ও ফাইজা করিম ফীমাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
জরিপটির ফলাফল বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্র রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন। এর বিপরীতে ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্র রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন। ১ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, দলীয় ছাত্র রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
তাছাড়া দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিকল্প হিসেবে ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও দলীয় ছাত্র রাজনীতির প্রশ্নে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘শুধুমাত্র ছাত্রসংসদ চান, তবে দলীয় ছাত্র রাজনীতি চান ন ‘ বলে মতামত দিয়েছেন।
ছাত্র রাজনীতির মূল প্রভাব হিসেবে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্ষমতার অপব্যবহারকে উল্লেখ করেছেন। ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ, ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ভয়ংকর গেস্টরুম কালচার, ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা, ৭৪ দশমিক ১ শতাংশ দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থতা, ৬৮ দশমিক ৭ শতাংশ জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাব, ১১ দশমিক ৪ শতাংশ নেতৃত্বে সুযোগ সৃষ্টি, ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি এবং ৪ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য প্রভাব উল্লেখ করেছেন।
জরিপের ফলাফলে আরও দেখা যায়, ক্যাম্পাসভিত্তিক বা হলভিত্তিক দলীয় ছাত্র রাজনীতির কমিটি প্রদানকে ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সমর্থন করেন না। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতির সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং সমর্থন করেন কি?’
এমন প্রশ্নে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতির সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং সমর্থন করেন না। ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রমের কারণে তাদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। দলীয় ছাত্র রাজনীতি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘খুবই অসন্তোষজনক’, ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘অসন্তোষজনক’, ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘মধ্যম’, ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘সন্তোষজনক’ এবং ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘খুবই সন্তোষজনক’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতি প্রকৃত অর্থেই জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে সক্ষম নয় বলে মনে করেন ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। রাজনৈতিক কার্যক্রমের ফলে ৭৪ শতাংশ শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আছে বলে উল্লেখ করেন, অপরদিকে মাত্র ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর নেতিবাচক অভিজ্ঞতা নেই বলে মতামত প্রকাশ করেন। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন না। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই (জরিপে অংশগ্রহণকালীন সময়ে) বলে জানিয়েছেন।
ঢাবি রিসার্চ সোসাইটি জানায়, গত ৩ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৮টি বিভাগ ও ১০টি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন, যেখানে মোট অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ২২৩৭ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সেশন ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থীরা মূলত এই জরিপটিতে অংশগ্রহণ করেছেন। গবেষণা পরিকল্পনা হিসেবে ক্রস সেকশনাল সার্ভে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেশনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলীয় রাজনীতি নিয়ে তাদের ধারণা, অভিজ্ঞতা এবং মতামতের বৈচিত্র্য বুঝতে সেই সামগ্রিক এবং সমন্বিত চিত্র তুলে ধরেছে। জরিপ পরিচালনায় সব তথ্য ও উপাত্ত অনলাইন সার্ভের (গুগল ফর্ম) মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপটি পরিচালনার পূর্বে একটি পাইলট সার্ভে করা হয়েছে। জরিপের প্রশ্নাবলী ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ’-এর ভেরিফাইড অনলাইন ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ থেকে সার্কুলেট করা হয়েছিল। সে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব প্ল্যাটফর্মে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছিল।
গবেষণা জরিপের ফলাফল অনুযায়ী কিছু সুপারিশ করেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটি। সেগুলো হলো- দলীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ; ডাকসু পুনর্জীবিত ও সংস্কার একটি স্বচ্ছ শিক্ষার্থীবান্ধব এবং জবাবদিহিতামূলক ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত রাখতে এবং তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরার একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে; শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন কমিটি গঠন; শিক্ষার মান উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন কমিটি গঠনের পাশাপাশি নিয়মিত ছাত্র-শিক্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।