কারো মৃত্যু হলে আমরা বলে থাকি, তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সাংবাদিক হলে বলি, সাংবাদিকতার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই কথাটা আমরা সাধারণত প্রয়াতের সম্মানে বলে থাকি। খুব কম সংখ্যক মানুষের সঙ্গে এ কথা যথার্থ হয়। সেই কম সংখ্যকের অন্যতম হলেন মিজানুর রহমান খান। একে তো মাত্র ৫৩ বছর বয়সে প্রয়াত হওয়ার অনাকাংখিত ঘটনাটিকে আমরা অকাল প্রয়াণ বলতে পারছি। উপরন্তু, তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে মধ্যাহ্নভোজের এক সাম্প্রতিক আড্ডায় সময়ের অন্যতম স্বনামধন্য সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বিষয়টি আরও স্পষ্ট করলেন। তার ভাষ্যে, ‘আমরা যে বলে থাকি, অমুক সাংবাদিকের মৃত্যুতে সাংবাদিকতার বড় ক্ষতি হয়ে গেলো, মিজানুর রহমান খান তার আদর্শ উদাহরণ। অপূরণীয় ক্ষতি মানে যে ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। মিজানুর রহমানের মৃত্যুর ক্ষতিও পূরণ হয়নি। তার মতো করে আর কেউ লিখছে না। কাউকে চেষ্টা করতেও দেখছি না। তাই সংবিধান, আইন-আদালত, কূটনীতি নিয়ে তার মতো করে আর কাউকে নির্দেশনামূলক বিশ্লেষণি প্রতিবেদন লিখতে দেখছি না।’
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন-‘ তার মানে, মিজানুর রহমানের মৃত্যুতে আমাদের সাংবাদিকতার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।’
গতকাল মঙ্গলবার মিজানুর রহমান খানের ছোট ভাই, আমার এক সময়ের সহকর্মী মসিউর রহমান খান তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আগামীকাল ১১ জানুয়ারি বুধবার প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান খানের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।’
ওই পোস্টে প্রায় শত মন্তব্যকারীর একজন হলেন আমার আর এক সাবেক সহকর্মী ও রাজনীতি গবেষক বন্ধুবর জাকির হোসেন। তিনি লিখেছেন, ‘মিজানুর রহমান খান ছিলেন নিষ্ঠাবান সাংবাদিক। গবেষণার স্বার্থে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পরিশ্রম করেছেন। তার মতো নিষ্ঠাবান সাংবাদিক বর্তমান সময়ে একজনও নেই। তার মৃত্যু বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আমার সহপাঠী বন্ধু ও এখনকার বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুর রহমান একটা নিবন্ধ লিখেছিলেন ল রিপোর্টার্স ফোরামের ম্যাগাজিনে। তাতে বলেছেন, ‘১২ জানুয়ারি ২০২১ সুপ্রিমকোর্টে অনুষ্ঠিত হলো সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের জানাযা। সুপ্রিমকোর্টে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ছাড়া কারো জানাযার তেমন নজির নেই। মিজানুর রহমান খান আইন সাংবাদিকতার একজন সফল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে তার জানাযায় শুধু আইনজীবীরাই নন, বিচারপতিরাও অংশ নেন। সুপ্রিমকোর্টে একজন সাংবাদিকের জানাযা এবং তাতে বিচারপতি ও আইনজীবীদের অংশগ্রহণ সাংবাদিকতায় বিশেষ করে আইন সাংবাদিকতায় মিজানুর রহমান খানের অবদানেরই স্বীকৃতি।’
মিজানুর রহমান খানের শূন্যতা পূরণ হবার নয় বলে মনে করেন তিনিও।
মিজানুর রহমান খান ছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ। সংসদ, আইন, কূটনীতি ইত্যাদি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক। তার আয়াসলব্ধ গ্রন্থগুলো পাঠকমহলে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। তার মৃত্যুর পরও প্রকাশিত হয়েছে বেশ কটি গ্রন্থ। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে প্রকাশিত তার ‘মার্কিন দলিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ এর ১১ জানুয়ারি সৎ, সাহসী ও সদা অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের অকালমৃত্যু হয়। এটা একদিকে যেমন তাঁর পরিবার, তেমনি প্রথম আলো এবং সর্বপরি দেশের সাংবাদিকতার জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর এ শূন্যতা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।’
আমরা দেখেছি, মরণশীল মানুষ তার কর্মে বেঁচে থাকেন। সময়ের সীমা ছাড়িয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারেন। এই ছড়িয়ে পড়ার বাহন হয় ভালো কাজ। মিজানুর রহমান খান এমনই একজন মানুষ। যিনি অনেক ভালো কর্মে প্রজন্মগত সীমারেখা অতিক্রমের ভিত গড়ে হারিয়ে গেছেন। তার অকাল প্রয়াণের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা আমাদের জন্য যে কতোটা কঠিন, তা প্রতিনিয়তই স্পষ্ট হচ্ছে।