মিত্রভাব বজায় থাকলে সব সঙ্কটই পার হওয়া যায়— বছর দুয়েক আগে ভারত সফরের শুরুতে বলেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই দেশের যৌথ যাত্রায় সম্ভবত এই কথাটিই সবচেয়ে বড় মন্ত্র হয়ে থেকেছে এ-যাবৎ। কারণ, ভারতের দিক থেকে দেখলে, বাংলাদেশ তুল্য বড় বন্ধু এই উপমহাদেশে তার আর নেই। অন্য দিকে, কূটনৈতিক তথা বর্তমান শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কম গুরুত্বের নয়। আর এই মৈত্রীর সুবাদেই হয়তো তিস্তা প্রকল্পে চীনের সাহায্যের প্রস্তাব সত্ত্বেও ভারতকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, গত জানুয়ারিতে দেশের নির্বাচনে জয়ের পরে প্রথম বিদেশ সফর ভারত যাত্রা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের অন্যতম মুখ্য বিষয় ছিলো বহুকালের অসমাপ্ত তিস্তা জলবণ্টন সংক্রান্ত পদক্ষেপ। শীঘ্রই ভারতের তরফে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ যাবে— এমনটাই স্থির হয়েছে।
তবে এই সমঝোতা পুনরায় উস্কে দিয়েছে জলবণ্টন বিষয়ক কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, রাজ্যকে বাদ রেখেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে আলোচনা ও ফরাক্কা-গঙ্গা চুক্তি নবীকরণের পথে এগিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় শাসনকালে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির প্রচেষ্টার সময় থেকেই এ-হেন পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা, উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের ক্ষেত্রে পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম উৎস এই নদী।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে অরণ্যচ্ছেদ এবং পরিবেশ পরিবর্তনের মতো বিবিধ কারণে সাম্প্রতিক কালে হ্রাস পেয়েছে তিস্তার পানি। এমতাবস্থায় রাজ্যের যুক্তি, অনাবৃষ্টির মৌসুমে বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ভাগাভাগি হলে আরও কমবে নদীর পানি। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উত্তরবঙ্গের মানুষ। বহু জায়গায় সেচের পাশাপাশি টান পড়বে পানীয় জলের সরবরাহেও। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি— পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থ সর্বাগ্রে, যার সঙ্গে কোনও মূল্যেই আপস করা উচিত নয়। তিস্তা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের যৌথ সম্পদ, এই বিষয়ক আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাদ পড়া ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর বিরোধী।
নিঃসন্দেহে, শুধু উত্তরবঙ্গই নয় এই নদী বাংলাদেশেরও জীবনরেখা, যেহেতু দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের শস্য উৎপাদন এবং বহু মানুষের জীবনজীবিকা তার উপর নির্ভরশীল।
লক্ষণীয়, দুই দেশের সমাজ ও অর্থনীতির পক্ষেই নদীজল কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই পানির ভাগবাঁটোয়ারাকে গুরুত্ব দিয়ে ত্রিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই কাম্য। এ দিকে বাংলাদেশেও যেমন তিস্তা চুক্তি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতেও তা-ই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বহু কাল ধরেই বলে আসছেন, ভারতে বিষয়টি কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে আলোচনাসাপেক্ষ। এই পরিস্থিতিতে নতুন কোনও সমাধান খোঁজা অত্যাবশ্যক। যত শীঘ্র তার হদিস মেলে, দুই দেশের মানুষ এবং দুই দেশের সম্পর্কের পক্ষে মঙ্গল। (আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়)