দীপক কুমার রায়, দৈনিক শিক্ষাডটকম: বয়স্ক বাবা যখন আমাকে বলেন, বাবা তুমি চলে যাবে? এই কথাটা বলার পর চোখের জল ধরে রাখতে পারি না! কী বলবো? ছলছল জল ভরা চোখ নিয়ে শেষে কর্মস্থলে ফিরতে হয়। বাড়িতে বয়স্ক বাবার সেবা যত্ন করতেন আমার স্ত্রী, বিশেষ করে চায়ের কাপটা সময় মতো পেলেই বাবা খুশিতে থাকতেন। কিন্তু চাকরির টানে বউকে নিয়ে আসতে হলো আমার সঙ্গে। প্রয়োজন মতো অর্থও দিতে পারি না। মাঝে মাঝে নিজেকে এতোটাই অসহায় লাগে যে নীরবে কান্না চলে আসে।
আমি দীপক কুমার রায়, চাকরি পেয়েছি নোয়াখালী জেলা বেগমগঞ্জ উপজেলার কাদিরপুর ইউনিয়নে শহীদ আহমদ আলি মহিলা আালিম মাদরাসায় গণিত শিক্ষক হিসেবে। আমরা শিক্ষক, এমপিও শিক্ষকদের বদলি চাই। আগামী এনটিআরসিএ’র গণবিজ্ঞপ্তির আগে ঐচ্ছিক বদলি চালু হলে শিক্ষকেরা নিজ নিজ এলাকায় বা কাছাকাছি আসতে পারবেন। অল্প বেতনে শহরে যেতে চাই না, বাড়ির পাশে গ্রামের প্রতিষ্ঠানে যেতে চাই। যেখানে ডাল ভাত খেয়ে বাঁচতে চাই।
আমার মতো হতভাগা দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে পরিবারকে ছেড়ে চাকরি করছেন লাখো শিক্ষক। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি না থাকায় নানা ভোগান্তির মুখে পড়েছেন । ভেঙে যাচ্ছে নারী শিক্ষকদের পরিবার। প্রতিষ্ঠান থেকে ৭০০ কিলোমিটারের মতো দূরে নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলায় আমার বাড়ি। মা ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তখন থকে বাবাই সব। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও বয়স্ক বাবাকে দেখতে যেতে পারি না। যে বেতন পাই, তাতে বাড়িতে ঠিকমত টাকাও পাঠাতে পারি না। এই অর্থে আসলে এলাকা ছেড়ে থাকাটা খুবই কষ্টকর। বাড়ি যেতে পারি না নিয়মিত। একবার গেলে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এতো টাকা কই পাবো।
আমরা হাইকোর্টে গিয়েছিলাম আমাদের পক্ষে নির্দেশেনা এসেছে বলে উকিল সাহেব বলেছেন কিন্তু মন্ত্রণালয় ওই বিষয়ে অবগত নয় বলে গণমাধ্যমের খবরে জেনেছি। আদেশের কপি না পাওয়ায় শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র প্রিন্ট জাতীয় পত্রিকা ওই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো প্রতিবেদন বা সম্পাদকীয় প্রকাশ করেনি। এছাড়া আপিল বিভাগ এখনও বাকী। শিক্ষা সংক্রান্ত অধিকাংশ বিষয়ই দেখেছি হাইকোর্টে পক্ষে এলেও আপিলে হেরে যায়। তারপরও আমাদের অগ্রগতি নেই। এটা আমাদের চরম দুর্ভোগ। এমনও হয় যে-আমাদের পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করলেও আমরা যেতে পারি না। আর অর্থনৈতিক কারণতো আছেই।
২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বরাবরের মতোই এমপিওভুক্ত শিক্ষক বদলির নীতিমালা তৈরির কথা উল্লেখ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০২১ জারি করে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠান শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সমপদে ও সম স্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার প্রতিবেদনে জানতে পারি, এই কার্যক্রমটি থমকে থাকার পেছনেও বেশকিছু কারণ আছে। যেমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বতন্ত্র, আলাদা ধরন ও মানের পরিবর্তন থাকায় এটি নিয়ে গত ২০ বছরে একাধিকবার আলোচনা ও উদ্যোগ হয়েও সুফল আসেনি। এ ছাড়া পরিচালনা কমিটি আলাদা শিক্ষক কর্মচারীর নিয়োগে ভিন্নতা, বেতনভাতা ও পদোন্নতি নিয়েও আলোচনার টেবিলে জটিলতা দেখা দেয়। এরপর করোনার কারণে এতে চলে আসে ধীরগতি। খাতা-কলমে ও টেবিলের দ্বিমতের কারণে শিক্ষকদের দুঃখগাঁথা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সর্বশেষে ৫ মে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এ আশা করছিলাম শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্তে একটি বদলি নীতিমালা পাবো কিন্তু সেদিনও আশার মুখ দেখলাম না। ওই সভায় হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। অথচ আমাদের আইনজীবীর কথা শুনলে মনে হয় পেয়ে গেছি। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের কিছু আলাদা বিষয় রয়েছে সেগুলো আইনজীবীরা মোয়াক্কেলদেরকে খোলাসা করেন না বলে শুনেছি।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রতিবার বিজ্ঞপ্তি দেয়ার আগে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের একটা সুযোগ দেয়া উচিত। বিদ্যমান নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত উভয় প্রকার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান শূন্য আসনে নতুন নিয়োগের পূর্বে স্বেচ্ছায় বদলির আবেদন চেয়ে এনটিআরসিএ প্রয়োজন মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারে। বিজ্ঞপ্তি অনুসারে সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমপদে ও একই বিষয়ে কর্মরত সমঅভিজ্ঞ ইন্ডেক্সধারী আগ্রহী শিক্ষকদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনলাইনে পছন্দক্রম দিয়ে আবেদন করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
তাতে করে, একই প্রতিষ্ঠানের একই বিষয়ে ও পদে একাধিক আবেদনকারীর মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আইসিটি জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রকাশনা, চারিত্রিক গুণাবলি, সহশিক্ষা ইত্যাদি এরসঙ্গে দূরত্ব বা জেলা ও উপজেলা কোটা বিবেচনা করে বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এভাবে বদলি কার্যকর হবার পর যেসব প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ সৃষ্টি হবে সেগুলোতে বিধি মোতাবেক নতুন নিয়োগ প্রদান করা হলে হ্রাস পাবে শূন্যপদ নির্ধারণের জটিলতা।
অতএব, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনি আমাদের অভিভাবক। আপনার কাছে আকুল আবেদন, অনুরোধ করছি আমাদের শিক্ষক পরিবারকে বাঁচান। আমরা শিক্ষকেরা যে অসহায়!
লেখক: শিক্ষক, নোয়াখালী
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন ]