সমাজের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি সম্পত্তি দখল, কমিশন বাণিজ্য, ঘুষ নেয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সেসব অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। কিন্তু প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে অনিয়ম-দুর্নীতির কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি জানিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেয় সংস্থাটি। আর সেই সার্টিফিকেট নিয়ে তারা বীরদর্পে সমাজে সাদা মনের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগীসহ সমাজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার সাধারণ মানুষ হতাশা প্রকাশ করেন।
এ রকমই সহ¯্রাধিক ব্যক্তিকে গত দুই বছরে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ অর্থাৎ দায়মুক্তি কিংবা অব্যাহতি দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি। এই তালিকায় আছেন- সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, আমলা, এনবিআর, রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কর্মকর্তা। দুদকের এই ক্লিন সার্টিফিকেট নিয়ে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ ও প্রশ্ন উঠলেও কমিশন বলছে- যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি কেবল তারাই পেয়েছেন দুদকের অব্যাহতি।
দুদক সূত্রে জানা যায়- গত ২ বছরে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, পুলিশ, আমলা, এনবিআর এবং রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার এক হাজারের বেশি ব্যক্তিকে অনুসন্ধান পর্যায়ে অব্যাহতি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকে আসা উল্লেখযোগ্য অভিযোগের মধ্যে তদন্ত শেষে যাদের ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেয়া হয়েছে তাদের একজন ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ আসে। তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল- কমিশন বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন। এরপর অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্যাকবকে অব্যাহতি দেয় দুদক। এছাড়া ২০২০ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ ছিল। এমনকি তখন তার সম্পদের হিসাবও নেয়া হয়। কিন্তু ২০২১ সালের মার্চে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় কমিশন।
কমিশন সূত্রে জানা যায়- ২০২১ সালে ৭৫৩টি এবং গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৩১২টি ফাইল অনুসন্ধান পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব তালিকায় রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নুরুল আনোয়ার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনজুরুল আলম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক এ কে এম মমতাজ উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডর সদস্য এস এম হুমায়ূন কবীর, ডেসকোর প্রধান প্রকৌশলী এনামুল হক, যুগ্ম সচিব জালাল আহম্মেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপকর কমিশনার হুমায়ূন কবীর, বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল বাশার পাটোয়ারি, সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহা, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপসচিব দিপংকর রায়, যমুনা অয়েলের জিএম মাসুদ করিম, যমুনা অয়েলের ডিজিএম (অর্থ) মোহাম্মদ খসরু আজাদ, যমুনা অয়েলের এজিএম (অর্থ) মোহাম্মদ আবুল বশরসহ ১ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে অব্যাহতির চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এদিকে ২০২২ সালে কমিশনে প্রায় ২০ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। যার মধ্যে কমিশন ৮৪০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়। এছাড়া ৩০৬০টি অভিযোগ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয় ব্যবস্থা নিতে। আর ১৪ হাজার ১১৯টি অভিযোগের বিষয়ে কিছুই করা হয়নি। হিসাবের খাতায় সংখ্যার পরিমাপে দুদক ২২ সালে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ অভিযোগ আমলে নিয়েছে। অপরদিকে ২০২১ সালে দুদকে মোট অভিযোগ জমা পড়ে প্রায় ১২ হাজার, ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি। ফলে কমিশনে অভিযোগ জমার পরিমাণ বাড়ছে কিন্তু অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত কমছে। এছাড়া ২০২২ সালে ৩৫০টির বেশি অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে কমিশন। একই অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ শতাধিক, মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রায় ২৮০টি এবং চার্জশিট দেয়া হয়েছে প্রায় ১৭০টি এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ৭৮টি। এছাড়া দুদকে বর্তমানে ৩ হাজার ৫৭৮টি অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে আর মামলা চলমান আছে ১৭০০টি।
দুদকসংশ্লিষ্টরা বলছেন- দুদক কোনো অভিযোগ আমলে নিলে প্রথমে অনুসন্ধান, তারপর মামলাপরবর্তী তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়ে থাকে। এরপর বিচারপ্রক্রিয়া। অর্থাৎ অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। আর এতে লেগে যায় বছরের পর বছর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় যুগও লেগে যায় মামলা নিষ্পত্তিতে। এ রকমও অসংখ্য নজির রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আসামিরা আইনি সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা পান। অনেক আসামি বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই পরপারে পাড়ি জমান। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত- দুদকের ক্লিন সার্টিফিকেট দেয়া উচিত নয়। দুদকের উচিত- সংস্থাটিতে আসা অভিযোগের অনুসন্ধান-তদন্ত শেষ করে যথাসময়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা। তারপর বিচারপ্রক্রিয়া থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তি মুক্ত হলে সেটি নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। কিন্তু দুদক যখন প্রাথমিক অনুসন্ধান পর্যায়ে কাউকে দায়মুক্তি কিংবা ক্লিন সার্টিফিকেট দেয়, তখন সংস্থাটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ ওঠা অবান্তর নয়।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবিও মনে করে- ক্ষমতার সঙ্গে থাকা প্রভাবশালীদের সম্পদের হিসাব তলবের পাশাপাশি এসব ব্যক্তিকে দুদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু দুয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া তাদের বেশির ভাগকেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। এ ধরনের কিছু ভূমিকার কারণে দুদক নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের চোখে সবাই সমান। এই বিষয়টি প্রমাণ করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এসব ঘটনা। দুদককে আরো শক্তিশালী এবং কঠোর হতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তারা সবাই ভালো সেটাও কিন্তু নয়। কোনো কিছু না ঘটলে বা না হলে কিন্তু অভিযোগ আসার কথা নয়। আমরা দেখেছি অতীতে বড় বড় রাঘব বোয়ালদের দায়মুক্তি দিয়েছে কমিশন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, গত ২ বছরে অনেক প্রভাবশালীকেও আইনের আওতায় এনেছে কমিশন। এই কমিশন আসার পর একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে। শুধু দায়মুক্তি নয়, দায়বদ্ধতার কথাও বলতে হবে। একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি। কমিশনের চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। দুর্নীতির প্রমাণ পেলে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।