মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং সাবেক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সিকি শতাব্দীর ব্যবধানে দু্টো বিরল ঘটনা ঘটিয়েছেন।
বাংলাদেশের শ্রম আইনের একটি সংশোধিত বিল জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পর স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁর এই বিরল পদক্ষেপের কারণে বিলটি এখনই আইনে পরিণত হচ্ছে না।
গত ২৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদ সচিবালয় রাষ্ট্রপতির দেওয়া মতামতসহ এই বিষয়ে একটি বুলেটিন প্রকাশ করেছে। ওই বুলেটিনে রাষ্ট্রপতির মতামতের অংশে বলা হয়েছে, “এই বিলের দফা-৪৫ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই উক্ত দফা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানো হলো।”
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ১৫ দিনের মধ্যে কোনো বিলে সম্মতি দিলে সেটি আইনে পরিণত হবে। তবে সংসদে পাসকৃত কোনো বিল পুনর্বিবেচনা বা বিলের ওপর নিজের প্রস্তাবিত সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে বিল সংসদে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে।
যদিও রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের নজির আমাদের দেশে অতি বিরল।
সর্বশেষ ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সপ্তম সংসদে পাস হওয়া ‘দি কোড অব সিভিল প্রসিডিউর (সংশোধন) বিল, ১৯৯৮’ স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
এবার যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রম আইন পাস হয়। একাধিকবার এই আইন সংশোধন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার চলতি মেয়াদের শেষ দিকে আবারও আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।
মূল আইনের ২৯৪ ধারার প্রথম উপধারায় বেআইনি ধর্মঘট শুরু করা বা অব্যাহত রাখার জন্য শ্রমিকের বিরুদ্ধে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একইভাবে আইনের দ্বিতীয় উপধারায় বেআইনিভাবে কারখানা বন্ধ রাখার জন্য মালিকের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. তৌফিকুল আরিফের মতে, শ্রম আইনের সংশোধনী চলার সময় মন্ত্রিসভা মূলত দ্বিতীয় উপধারাটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কারখানা বেআইনিভাবে বন্ধ করলে বা সেটি চালিয়ে গেলে মালিকের শাস্তি বৃদ্ধি হওয়ার কথা।
কিন্তু জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হওয়া সংশোধন বিলে দেখা গেছে, মালিকের শাস্তি বাড়ানোর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে, তবে শ্রমিকের শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে ‘বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি হতে পারে বলে মন্তব্য করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০২৩’ স্বাক্ষর না করে সংসদের কাছে ফেরত পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য শাজাহান খানের মতে, ‘এটি মন্ত্রণালয়ের ভুল। হয়তো তারা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মালিকের পরিবর্তে কেবল শ্রমিকদের শাস্তি বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।’
তিনি মনে করেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে বিষয়টি সংশোধন করা যেতো। তবে যেখানেই হোক ভুলটি ধরা পড়েছে সেটিই বড় কথা।
সংশোধনীর প্রেক্ষাপট
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনার পর বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পোশাক আমদানিকারক দেশগুলো সরকারকে কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া সহজীকরণের বিষয়ে তাগিদ দিতে থাকে। বিশেষ করে, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে স্থাপিত কল-কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে দেশগুলোর চাপ ছিলো।
শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ ছিল, এসব কারখানায় ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ না থাকায় মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের কোনো সুরক্ষাকবচ নেই। অপরদিকে মালিকপক্ষের অনেকেই শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ে নিজেদের বিরূপ মনোভাব প্রকাশে রাখঢাক রাখেননি।
এরই প্রেক্ষাপটে সরকার ফের শ্রম আইন সংশোধনের দীর্ঘ উদ্যোগ নেয়। নতুন সংশোধনীতে কল-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়েছে।
সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মোট শ্রমিকের সংখ্যা ৩,০০০ পর্যন্ত হলে ২০ শতাংশ এবং এর বেশি হলে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে। বিদ্যমান আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে শ্রমিক সংখ্যা নির্বিশেষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের লিখিত সম্মতি প্রয়োজন হয়। প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ক্ষেত্রে আগের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত আইনে নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ১২০ দিন করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়াও ‘মহিলা’ শব্দের পরিবর্তে প্রথমবারের মতো ‘নারী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
গত ২৯ অক্টোবর একাদশ সংসদের শেষ অধিবেশনে বাংলাদেশ শ্রম আইনের বেশ কয়েকটি ধারায় সংশোধন এনে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০২৩’ সংসদে উত্থাপন হয়। পরে মাত্র তিন দিনের সময় দিয়ে সংসদে রিপোর্ট উপস্থাপনের জন্য বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে গত ২ নভেম্বর কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। এরপর ৮ নভেম্বর বিলে সম্মতির জন্য পাঠালে একটি দফা পুনর্বিচেনার জন্যে ২০ নভেম্বর তা ফেরত পাঠান রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি ফেরত পাঠানোর পর এখন নতুন নির্বাচনের পর দ্বাদশ সংসদ দায়িত্ব গ্রহণের পরই কেবল বিলটির পুনর্বিবেচনা সম্ভব।
সংসদ ওই বিলটি সংশোধনীসহ বা সংশোধনী ছাড়াই পুনরায় গ্রহণ করলে সম্মতির জন্য সেটা আবারও রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সাত দিনের মধ্যে তাতে সম্মতি দেবেন। ওই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিতে অসমর্থ্য হলে সময় অবসানের পর (৭ দিন) বিলে সম্মতি দিয়েছেন বলে গণ্য হবে।
গতকাল মঙ্গলবার সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখার যুগ্মসচিব নাজমুল হক বলেন, ‘একাদশ সংসদের এখন অধিবেশন নেই। তাই বিলটি তামাদি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে নতুন সংসদে বিলটি নতুন প্রক্রিয়ায় (মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন, সংসদে উপস্থাপন, পাস) উত্থাপন করতে হবে।’
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।