এবার অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতকারী ইউনুস শরীফ নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার এক আসামিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার প্রচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক পদের নিয়োগ বোর্ড থেকে তাকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশটি এখন রিজেন্ট বোর্ডে অনুমোদিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
সুপারিশকৃত ইউনুস শরীফ বর্তমানে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০১৯ এর ৯ সেপ্টেম্বর তাকে ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৯০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।দুদকের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ছয়টি প্রকল্পের দরপত্র নিয়ে জালিয়াতি, প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২১ জুন থেকে ২০১৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে এ টাকা আত্মসাৎ করেন।
জেলহাজতে থাকায় পবিপ্রবি কর্মচারীর সাধারণ আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধির ৯(৪) ধারা অনুযায়ী ২৩ সেপ্টেম্বর তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে পবিপ্রবি প্রশাসন। পরবর্তীতে জামিনে মুক্তি পেলে তার সাময়িক বরখাস্তের আদেশটি স্থগিত করা হয়।
জানা গেছে, গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বশেমুরবিপ্রবির পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস দপ্তরের পরিচালক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে আবেদন করেন ইউনুস শরীফ। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনিসহ মোট তিনজন প্রার্থী ভাইভায় অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্রের দাবি, তার দুদকের মামালার আসামী হওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় অবগত রয়েছে। তা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইভা বোর্ড থেকে তাকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করা হয়।
সুপারিশের বিষয়টি নিশ্চিত করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিয়োগ বোর্ডের এক সদস্য বলেন, ভাইভায় যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন শুধু ইউনুস শরীফেরই প্রকৌশল ডিগ্রি ছিল। তাছাড়া তিনি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিলেন। তাই তাকে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রভাবিত হয়ে সুপারিশের ঘটনা ঘটেনি। ভাইভা বোর্ডে কার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ, সেটাও আমাদের জানা ছিল না।
তবে বোর্ড শেষে এ ধরনের অভিযোগের কথা শুনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সুপারিশ তো আর চূড়ান্ত নিয়োগ নয়। যদি এ অভিযোগের সত্যতা থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই সে অভিযোগ বিবেচেনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
এ বিষয়ে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, কার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ, সেটা বোর্ডের সদস্যদের দেখার বিষয় না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তৈরিকৃত শর্টলিস্ট অনুযায়ী ভাইভা নিই। তাদের সিভি দেখি, যোগ্যতা যাচাইয়ে প্রশ্ন করি এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অভিযোগ আছে কি নেই এগুলো সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় দেখবে। এখন কেউ যদি কোনো মামলার আসামি হয়, জেলে গিয়ে থাকে, অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলেতো তার নিয়োগ হলেও সেটি বাতিল হবে।
ইউনুস শরীফের সিলেকশনের বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়োগ বোর্ডের একজন হিসেবে কারও সম্পর্কে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। তবে আমরা সবচেয়ে যে ভালো তাকেই সিলেক্ট করেছি। একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ এবং প্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী পরিচালক প্রয়োজন যে বিষয়গুলো বুঝবে, প্রজেক্ট তৈরি করতে পারবে। নয়তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বশেমুরবিপ্রবির ট্রেজারার এবং নিয়োগ বোর্ডের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মো. মোবারক হোসেন বলেন, সিলেকশন বোর্ডে কোনো অনিয়ম হয়নি। নিয়োগও এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সিলেকশন বোর্ডের মতামত গোপনীয় বিষয়। এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।
নিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ কিউ এম মাহবুব বলেন, নিয়োগ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তাই আপনাদের কাছে যা অভিযোগ, আমাদের কাছে তা অভিযোগ নয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সব তথ্য দেখবে, বিশ্লেষণ করবে।
এদিকে, দুদক অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ২০২১ এর ২৬ ডিসেম্বর ইউনুস শরীফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। রিজেন্ট বোর্ডে বিষয়টি উত্থাপন হলে সিদ্ধান্ত হয় এ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। পরবর্তীতে আদালত থেকে ইউনুস শরীফ সিদ্ধান্ত আনলে তাকে স্বপদে বহাল রাখা হয়।
তবে অভিযোগ রয়েছে, অভিযুক্ত প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সকল তথ্য প্রমাণ থাকলেও পবিপ্রবি প্রশাসনের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি মামলা চলমান থাকা অবস্থায়ই তিনি স্বপদে বহাল আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পবিপ্রবির এক কর্মকর্তা বলেন, দুদক তো শুধু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিলেকশনে অনিয়মের বিষয়টা উদঘাটন করেছে। কিন্তু তিনি এসব প্রতিষ্ঠানকে যে কত কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে টেন্ডার দিয়েছেন, তা এখনও সামনে আসেনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তার দুর্নীতি সম্পর্কে জানি। কিন্তু যারা ব্যবস্থা নেবে তারাইতো ঘনিষ্ঠ লোক। আবার তাদেরও অনেক দুর্নীতির সাক্ষী তিনি। তাই সবাই সমঝোতায় চুপ থাকে।
তিনি আরও বলেন, শুনেছি কিছুদিন পর তিনি গোপালগঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ বেশি থাকে, দুর্নীতির সুযোগও বেশি থাকে। আর তাছাড়া প্রশাসন বদলালে তার এখানকার চাকরি চলে যেতে পারে। এ কারণেই তিনি সেখানে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইউনুস শরীফ বলেন, হ্যাঁ আমি হাজতে ছিলাম, তাতে কি হইছে? এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বুঝবে। এসব জিজ্ঞেস করার আপনি কে? আমি আপনাকে ফোনে কিছু বলবো না।
দুদকের পটুয়াখালী সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, আমার জানামতে মামলাটি এখনও চলছে। আপনি আগামী সপ্তাহে ওয়ার্কিং ডে-তে যোগাযোগ করলে কাগজপত্র দেখে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবো।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উপাচার্য ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বলেন, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, মামলা চলছে এটা সত্য। তবে আগের উপাচার্য থাকাকালীন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মামলা চলমান থাকলেও জামিনে মুক্ত থাকলে তিনি স্বপদে বহাল থাকতে পারেন। তিনিই বরখাস্তের আদেশ রহিত করে স্বপদে বহালের আদেশ দিয়েছিলেন। এখনও সেই আদেশই বহাল আছে। আমাদের যদি মনে হয় যে, সে আবারও কোনো দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে তবে আমরা ব্যবস্থা নেব।
নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কাম্য নয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় কিছুদিন পরপরই এসব বিতর্কিত কাজের জন্য আলোচনায় আসে। বিশ্ববিদ্যালয়টির এসব থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।