নতুন আয়কর আইন পাশ হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতা খর্ব হবে। চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করবে নতুন এ আইন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০০৪ সালের দুদক আইন ও দেশের সংবিধানের সঙ্গে নতুন আয়কর আইন সাংঘর্ষিক। আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে আয়কর আইনের এই ধারা হুমকির মুখে পড়বে। শনিবার (২৪ জুন) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মাহবুব আলম লাবলু ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদকে বেশকিছু আয়কর কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান। এছাড়াও সম্প্রতি রাজশাহীতে ঘুসের টাকাসহ এক আয়কর কর্মকর্তা দুদকের হাতে গ্রেফতার হন। এসবের জের ধরেই কূটকৌশল হিসাবে নতুন আইনে আদালতের অনুমতি ছাড়া দুদককে তথ্য না দেওয়ার বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে। সংসদে উত্থাপতি নতুন আয়কর আইন বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘শুধু ২০০৪ সালের দুদক আইন নয়, দেশের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নতুন আয়কর আইন। কাউকে হাত-পা বেঁধে দিয়ে পানিতে সাঁতার কাটতে বললে তার যে অবস্থা হবে, এই আইন পাশ হলে দুদকের অবস্থাও হবে অনুরূপ। এই আইন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার একটা প্রয়াস। এমনিতেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদককে নানা চাপের মুখে পড়তে হয়। এই আইন পাশ হলে দুদকের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। আমরা মনে করি, কোনো অবস্থায়ই যেন এই আইন পাশ করা না হয়।
জানা যায়, দুদক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেসব মামলা করে থাকে এর বেশির ভাগই করা হয় অভিযুক্তদের আয়কর ফাইলের তথ্যের ওপর নির্ভর করে। দুদকের নোটিশের জবাবে অভিযুক্তরা যে সম্পদ বিবরণি জমা দেন তার সঙ্গে আয়কর ফাইলে উল্লিখিত তথ্য মিলিয়ে দেখেন অনুসন্ধান বা তদন্ত কর্মকর্তা। সম্পদবিবরণীর সঙ্গে আয়কর ফাইলের গরমিল পাওয়া গেলে সহজেই আদালতে প্রমাণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়।
এ কারণে দুদক কর্মকর্তারা নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসাবে অভিযুক্তের আয়কর ফাইল তলব করে থাকেন। এটাও করা হয়ে থাকে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর। নতুন আয়কর আইনে দুদক কর্মকর্তাদের এই সহজ তথ্যপ্রাপ্তির পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এখন দুদকের মামলা দায়ের অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণেই নতুন আয়কর আইনকে দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবজ হিসাবে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতি দমনে দেশের একমাত্র সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসাবে দুদককে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মামলার তদন্তকাজে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য চাওয়ার ক্ষমতা দুদক আইনেই রয়েছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ আদালতের কাছেও তথ্য চাইতে পারে দুদক। কিন্তু এনবিআর কূটকৌশল হিসাবে দুদকের তথ্যপ্রাপ্তির পথ রোধ করতে চাইছে। এটা হলে দুদকের ক্ষমতা চরমভাবে খর্ব হবে। দুর্নীতি দমনে গতি হারাবে প্রতিষ্ঠানটি।
আলাপকালে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নতুন আয়কর আইনে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য দুদককে শুধু আদালতের অনুমতির প্যাঁচেই ফেলা হয়নি, এক্ষেত্রে কূটকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। নতুন আয়কর আইনে বলা হয়েছে, দুদককে এনবিআরের কাছ থেকে তথ্য পেতে হলে আমলি আদালতের নির্দেশনা নিতে হবে। বাস্তবে আমলি আদালতে সঙ্গে দুদকের কোনো কাজ নেই। দুদক দুর্নীতি মামলার চার্জশিট দাখিল করে থাকে জেলা জজ আদালতে। ফলে তথ্যপ্রাপ্তির অনুমতি নিতে দুদক কর্মকর্তাদের প্রতিটি অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে আমলি আদালতে যাওয়াও সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর অনুসন্ধান ও তদন্তকার্যে কমিশনের বিশেষ ক্ষমতা সংবলিত ১৯ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন যে কোন ব্যক্তিকে অনুসন্ধান বা তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে কোন তথ্য সরবরাহ করার জন্য নির্দেশ দিতে পারবে। একই সঙ্গে অনুরূপভাবে নির্দেশিত ব্যক্তি তার হেফাজতে রক্ষিত উক্ত তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। ১৯ (৩) ধারায় আরও বলা হয়েছে, কোনো কমিশনার বা কমিশন থেকে বৈধ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তাকে উপধারা (১) এর অধীনে ক্ষমতা প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি বাধা প্রদান করলে বা উক্ত উপধারার অধীন প্রদত্ত কোন নির্দেশ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য করলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে। উক্ত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনূর্ধ্ব তিন বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের কারাদেণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দুদক আইনের এই ধারাকে অকার্যকর করতে নতুন আয়কর আইনে তথ্য সুরক্ষার নামে ৩০৯ (২) ধারায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ (২০০৪ সনের ৫নং আইন) বা আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনে উল্লিখিত ক্ষেত্র ব্যতীত, কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এই আইনের অধীন কোনো কার্যধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো রিটার্ন, হিসাব বা দলিলাদি, সংশ্লিষ্ট কোনো রেকর্ড, প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী কর্তৃক উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান বা সাক্ষ্য প্রমাণ তলব করতে পারবে না। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনীয় কোন কাগজাদি, বা কোনো বিবৃতি, রিটার্ন হিসাব, দলিলাদি, সাক্ষ্য, হলফনামা বা জমাকৃত বিষয়াদি প্রকাশ বা প্রদানের বিষয়ে আমলি আদালত আদেশ করবে কেবল সেক্ষেত্রে এসব প্রদান করা যাবে। দুদকের তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমলি আদালতের আদেশের কথা বলা হলেও সরকারি অন্যান্য সংস্থার তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো শর্তারোপ করা হয়নি। উত্থাপিত নতুন এই আয়কর আইনটি গত রোববার সংসদে পাশ হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে এনবিআর-এর সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে নতুন আয়কর আইনের এই ধারা হুমকির সম্মূখীন হবে। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্তে সূপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের বেশ কয়েকটি রায় আছে। এর আগেও সরকারী কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্য আইন করা হয়েছিল। আদালতে সেগুলো বাতিল হয়ে গেছে। প্রস্তাবিত আয়কর আইনের উল্লিখিত ধারা উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্তের পরিপন্থি। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চতর আদালত সবার ওপর বাধ্যতামুলক। রাষ্ট্র এমন কোনো আইন করতে পারবে না যা উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্তকে অকার্যকর করে। এক্ষেত্রে এটা আদালত অবমাননার পর্যায়েও পড়তে পারে।